রুদ্রবার্তা২৪.নেট: কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই! রাজধানী ঢাকার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালত, শিল্প-কলকারখানা, শপিং মল, মার্কেট, দোকানপাট-রেস্তোরাঁ—সব কিছুই চলছে পুরোদমে। গণপরিবহনেও ঠাসাঠাসি ভিড়। পথে-ঘাটে চলাফেরায় বা অলিগলিতে পথখাবারের দোকানেও নেই সামাজিক দূরত্বের কোনো চিহ্ন। ঢাকা থেকে বের হওয়া বা প্রবেশে দূরপাল্লার ট্রেন, বাস, লঞ্চে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকলেও থেমে নেই ভাঙা ভাঙা পথে মানুষের চলাচল। বিমানেও চলছে স্বাভাবিক যাত্রা। অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে গায়ে গায়ে ভিড় যাত্রীদের। বিমানের ভেতরে এক সিট ফাঁকা রাখার নির্দেশনা থাকলেও ঢাকার বাসের মতোই সেখানেও সব সিট পূরণ করেই চলাচল করছে বিমান। হাসপাতালের ইনডোর-আউটডোরেও একই রকম ভিড়ের চিত্র।
এমন অবস্থার মধ্যে ঢাকাকে করোনার সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় আশপাশের জেলাগুলোতে দেওয়া লকডাউন কতটা কাজে আসছে, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে মানুষের প্রতিদিনের হয়রানি নিয়েও। এ ক্ষেত্রে সব কিছু খোলা রেখে যাতায়াত বন্ধ রাখা যেমন বাস্তবসম্মত নয়, তেমনি সম্ভবও নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনার দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিশেষজ্ঞদের মধ্য থেকেই। তাঁরা বলছেন, ঢাকার চারপাশে যে জেলাগুলোতে লকডাউন দেওয়া হয়েছে এবং যাতায়াতের পরিবহন বন্ধ করা হয়েছে, সেই এলাকাগুলোর বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিদিনই বাড়ি থেকেই ঢাকার কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করেন। ফলে কর্মস্থল খোলা থাকলে তাঁদের কাজে যেতেই হবে যেকোনো উপায়ে। প্রতিদিন এসব হাজারো মানুষের দুর্ভোগের যাত্রা সহজেই চোখে পড়ে সকাল-বিকাল। শুধু ঢাকার আশপাশেরই নয়, দূরপাল্লার সব ট্রেন, বাস, লঞ্চ বন্ধ থাকলেও ঢাকা থেকে দূরবর্তী এলাকার মানুষও অতিরিক্ত খরচ দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন ছোট ছোট পরিবহন ব্যবহার করে ঢাকায় আসা-যাওয়া করছে। এমন পরিস্থিতি ঢাকাকে সুরক্ষায় এই নামমাত্র লকডাউন থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসবে না বলেও মনে করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বরং ঢাকার মধ্যের সব কিছু খোলা থাকায় এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে চারদিকের লকডাউন আদলের সুরক্ষা বেষ্টনী।
বিশেষজ্ঞরা এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে প্রয়োজনে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এমনকি পরামর্শকদের বিভিন্ন ফোরামে ঘুরেফিরেই অনেকে কারফিউ কিংবা সেনাবাহিনী মোতায়েনের মতো পদক্ষেপ নিতে বলছেন। তাঁদের মতে, সময় পেরিয়ে গেলে তখন কঠোর পদক্ষেপ নিয়েও ভালো ফল আসবে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য উদাহরণ হিসেবে অনেকেই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ শুরুর দিকে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সংক্রমণে এতটা বিস্তার ঘটেছে বলেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের দোষছেন। তবে অনেকে বলছেন, আগে যেভাবে সারা দেশে একবারে লকডাউন বা বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছিল, সেই কৌশল বদলে এখন স্থানীয়ভাবে জেলাভিত্তিক লকডাউন দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু এই বদলানো কৌশলেও খুব একটা সুফল মিলছে না। কারণ এরই মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ। ১০ শতাংশের ওপরেই সব জেলায় শনাক্ত; কোথাও কোথাও শনাক্ত হার ৬০-৯০ শতাংশ।
দেশে ১৪ দিনের সম্পূর্ণ শাটডাউনের সুপারিশ
করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে একটানা ১৪ দিনের সম্পূর্ণ শাটডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছে কভিড-১৯-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। গত বুধবার কমিটির ৩৮তম সভায় বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চ সংক্রমণ, পঞ্চাশোর্ধ্ব জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ করা যায়। রোগ প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ডভাবে গৃহীত কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অন্যান্য দেশ, বিশেষত পাশের দেশ ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এর বিস্তৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। তাঁদের মতামত অনুযায়ী যেসব স্থানে পূর্ণ শাটডাউন প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এবং জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডাউন দেওয়ার সুপারিশ করছে। জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সব কিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে।
সভায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছেন। এই রোগ থেকে পূর্ণ মুক্তির জন্য ৮০ শতাংশের ঊর্ধ্বে মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশ থেকে টিকা সংগ্রহ, লাইসেন্সের মাধ্যমে দেশে টিকা উৎপাদন করা ও নিজস্ব টিকা তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার প্রতি কমিটি পূর্ণ সমর্থন জানায়।
কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে : জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল রাতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারের প্রস্তুতি আছে, যেকোনো সময় কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার করোনা পরিস্থিতি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
মানুষ বেপরোয়া আচরণ করছে, থামানো যাচ্ছে না : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বিশেষজ্ঞরা তো নিয়মিতই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারও সে অনুসারে নির্দেশনা দিচ্ছে। কিন্তু পরামর্শ বা নির্দেশনা যদি বাস্তবায়ন করা না যায় তবে তো সংক্রমণ ঠেকানো মুশকিল হবেই। এ ক্ষেত্রে সবাইকেই দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতে হবে। মানুষকেও সতর্ক ও সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। কিন্তু মানুষ যেভাবে বেপরোয়া আচরণ করছে, সেটা তো থামানো যাচ্ছে না। তবে সবার মনে রাখা উচিত সংক্রমণ যদি হাসপাতাল উপচে পড়ে তবে কিন্তু কিছুই করার থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় এখন অনেক কিছু সংযোগ করা হয়েছে। বেড, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন অনেক বেড়েছে। কিন্তু রোগী যদি বহুগুণ বেড়ে যায় তবে যতই হাসপাতাল বা যন্ত্রপাতি বাড়ানো হোক, তাতে কুলোনো যাবে না, কোনো দেশ তা পারছে না; আমরাও পারব না।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ঢাকাকে সুরক্ষার জন্য আশপাশের জেলায় লকডাউন দেওয়া হয়েছে। তার পরও মানুষ ছুটছে ঢাকায়। ঢাকায় সব কিছু খোলা থাকায় মানুষ নানা অজুহাতে হেঁটে আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও চলাচল নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। এতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও কম থাকবে।
নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘পরিকল্পনা তো কত কিছুই করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা না গেলে এর সুফল আসবে কী করে! আমরা তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জায়গা থেকে রাস্তায় নেমে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারব না। দোকানপাট, মার্কেট বন্ধ রাখা বা মানুষ মাস্ক না পরলে ব্যবস্থা নিতে পারব না।’
টিকা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের তো চেষ্টার কমতি নেই। প্রতিদিনই আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলছি, চিঠি চালাচালি করছি। সবাই আশ্বাস দেয়, কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ জানাতে পারছে না।’ মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু কোভ্যাক্সের কাছ থেকেই আমাদের প্রায় সাত কোটি টিকা পাওয়া বুকিং রয়েছে। এ ছাড়া চীন ও ভারত থেকে বুকিং আছে আরো প্রায় চার কোটি ডোজ টিকার। চীনের সঙ্গে চুক্তির আওতায় এই মাসেই কিছু টিকা আসার কথা ছিল, কিন্তু এই মাস তো প্রায় শেষ, এখনো আসেনি। আগামী মাসেও আসার কথা রয়েছে আরো কিছু। রাশিয়ার কাছ থেকেও টিকা আনার কাজ চলছে।’
সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতেই হবে : বিশেষজ্ঞরা
কভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার চারপাশে বসবাসকারী যেসব মানুষ ঢাকায় চাকরি বা কাজ করে, তাদের চাপে ভেঙে পড়েছে লকডাউনের সুরক্ষাবলয়। এখন আর এই লকডাউন দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে বলে মনে হয় না। বড়জোর সংক্রমণের গতি কিছুটা ধীর হতে পারে। কিন্তু ভারতীয় ভেরিয়েন্টের যে চেহারা দেখছি, তাতে এই ধীরগতি রাখার পরিকল্পনা বা কৌশল খুব একটা কাজে খাটবে না। মোটের ওপর পরিস্থিতি এখন এমন যে মানুষও এক রকম মহামারির সঙ্গে গা-সওয়া অবস্থায় আছে, আর সরকারও হয়তো তেমনি গাছাড়া ব্যবস্থায় আটকে আছে।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, কমপক্ষে দুই সপ্তাহ পূর্ণাঙ্গ লকডাউন না দিলে কখনো সুফল আসবে না। আবার দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনও কোনো সমাধান হতে পারে না। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং নিজের সুরক্ষায় সচেতন হতেই হবে; আবার সরকারকেও প্রয়োজনে বৃহত্তর স্বার্থে আরো কঠোর পদক্ষেপে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে মানুষকে সম্পৃক্ত করে কর্মকৌশল বাস্তবায়নে কাজ করা।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন নিশ্চিত করেই বলা যায় দেশ আবার সংক্রমণের উচ্চধাপে উঠে গেছে। এখন আর বিচ্ছিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণে ফল পাওয়া যাবে না। দেশের সব জেলায়ই এখন শনাক্ত হার ১০ শতাংশের ওপরে। জাতীয়ভাবে তা ২০ শতাংশের ওপরে-নিচে ঘুরছে। ফলে এখন যতটা ঊর্ধ্বমুখীই হোক না কেন, একযোগে সারা দেশে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দুই সপ্তাহ পরে সংক্রমণ আবার নিচে নেমে আসবে। এ ক্ষেত্রে চলাচল বন্ধ করতে হলে চলাচলের কারণ বা উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ সব কিছুই বন্ধ করতে হবে কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আর্থ-সামাজিক বা জীবন-জীবিকার প্রশ্নের কিছু কিছু ক্ষেত্র জরুরি হিসেবে খোলা রাখা যেত, যদি ওই সব প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের যাতায়াতে নিজ নিজ উদ্যোগে পরিবহনের ব্যবস্থা করত। কিন্তু এর আগে আমরা দেখলাম, সরকার এমন পরিকল্পনা করেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিভিন্ন চাপে।’
ড. মুশতাক বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে বেশি করে টিকা দেওয়া গেলেও হয়তো কিছু ফল পাওয়া যেত। কিন্তু সেটাও তো হচ্ছে না।