চাঁদপুরের হাইমচরের মাঝিরচর এলাকায় এমভি-আল বাখেরা জাহাজে সংঘটিত সাত খুনের ঘটনার মূল হোতা আকাশ মণ্ডলকে (২৬) গ্রেফতার করেছে র্যাব। মঙ্গলবার রাতে আকাশ মণ্ডলকে বাগেরহাটের চিতলমারি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মূল হোতা আকাশ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেতন-ভাতার দ্বন্দ্বে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন।
গ্রেফতার আকাশ মণ্ডল বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার জগদীশ মণ্ডল ও মনিকা রানীর ছেলে। আকাশ পেশায় জাহাজের লস্কর। আট মাস ধরে সে এমভি-আল বাখেরা জাহাজে চাকরি করছিলেন। বুধবার সকালে কুমিল্লা নগরীর শাকতলা র্যাব কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব জানান র্যাব ১১ সিপিসি-২-এর উপ-অধিনায়ক মেজর সাকিব হোসেন।
সাকিব জানান, আকাশ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তিনি জানান, জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়ার দুর্ব্যবহার, বেতন-বোনাসে অনিয়ম এবং কর্মচারীদের প্রতি অবহেলা তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এ থেকেই আকাশ প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পরে, পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর তিনি তিন পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে রাখেন।
পরে, ঘটনার দিন ২২ ডিসেম্বর রাতে আকাশ তরকারির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সবাইকে অচেতন করেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে মাস্টারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেন। পরে অন্যরা টের পেয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় একে একে ছয়জনকে হত্যা করেন। আকাশের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডের পর তিনি নিজেই জাহাজ চালিয়ে মাঝিরচরে পৌঁছান। পরদিন সকালে ট্রলারে করে পালিয়ে যান এবং বাগেরহাটের চিতলমারিতে আত্মগোপন করেন।
র্যাব আরও জানায়, আকাশের কাছ থেকে রক্তমাখা জিন্স, মোবাইল ফোন, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা এবং অন্যান্য আলামত উদ্ধার করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে অন্য কোনো সহযোগী ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
৭ দিনের রিমান্ডে ইরফান
আসামি আকাশ মণ্ডল ইরফানের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার সন্ধ্যায় চাঁদপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্তকারী কর্মকর্তা নৌপুলিশের পুলিশ পরিদর্শক মো. কালাম খান আসামির ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মুহাম্মদ ফারহান সাদিক ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) শরীফ মাহমুদ সায়েম এই তথ্য নিশ্চিত করেন। মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শরীফ মাহমুদ সায়েম, মাসুদ প্রধানীয়া, ইয়াসিন আরাফাত ইকরাম ও মো. শাহজাহান খান। তবে আসামিপক্ষে কোনো আইনজীবী ছিল না।
রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শরীফ মাহমুদ সায়েম বলেন, জাহাজে ৭ খুন সারা দেশের আলোচিত ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে আদালতে উপস্থিত করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ব্যাপক শুনানি শেষে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আমরা আশাকরি এই আসামিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসবাদের মাধ্যমে আসামির সঙ্গে অন্য কেউ সংশ্লিষ্ট আছে কি না এবং রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার জন্য কেউ জড়িত আছে কি না তা বেরিয়ে আসবে।
এদিকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মুহাম্মদ ফারহান সাদিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ইরফানের বক্তব্য আছে কি না জিজ্ঞেস করলে বলে, মানুষ ভুল করে, আমিও ভুল করেছি। আমি যা স্বীকারোক্তি দিয়েছি তাই সত্য। আদালত যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমি তাই মাথা পেতে নেব।
মামলা দায়ের
জাহাজ মালিকদের পক্ষে মো. মাহবুব মোরশেদ বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় একটি মামলা করেন। মাহবুব মোরশেদের বাড়ি ঢাকার দোহার এলাকায়। এতে খুন ও ডাকাতির অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চাঁদপুর নৌ-পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান। এ ছাড়া সেভেন মার্ডারের ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয় ও চাঁদপুরের স্থানীয় প্রশাসন থেকে পৃথক ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
নড়াইলে দুইজনের দাফন
জাহাজে হত্যাকাণ্ডে শিকার সাতজনের মধ্যে নড়াইলের আমিনুর রহমান মুন্সী (৪৮) ও সালাউদ্দীন ফকিরের (৪০) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার (রাতে আমিনুর এবং সালাউদ্দিনের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। পরে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী রাতেই তাদের দাফন করা হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার আমিনুর রহমানের বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা ইউনিয়নের পাঙ্খারচর গ্রামে। তিনি মজিবুর রহমানের ছেলে। তিনি আল বাখেরা জাহাজের সুকানি ছিলেন। অন্যদিকে সালাউদ্দিন ছিলেন ইঞ্জিনচালক। তিনি একই উপজেলার লাহুড়িয়া ইউনিয়নের এগারোনলি গ্রামের আবেদ উদ্দীন ফকিরের ছেলে।