ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সব প্রতিক্রিয়া শোকের ছিল না। আফ্রিকা অঞ্চলের কয়েকটি দেশের তরুণরা রানির মৃত্যুতে শোক প্রকাশের পরিবর্তে তাদের পূর্বপুরুষদের ছবি এবং গল্প প্রকাশ করেছে। ওই মানুষগুলো রানি এলিজাবেথের দীর্ঘ শাসনামলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নির্মম সময় পার করেছিল।
টুইটারে একজন তার দাদীর মুভমেন্ট পাসের ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আমি শোক করতে পারি না।’
কেনিয়ায় ব্রিটিশ শাসনামলে এই মুভমেন্ট পাস দেওয়া হতো স্থানীয় বাসিন্দাদের। কারণ নিজেদের দেশে কেনিয়ানদের স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার দেয়নি ব্রিটিশরা।
আরেকজন দাদীর কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, দাদী ‘আমাদেরকে শুনিয়েছেন ঔপনিবেশিক আমলে কীভাবে তাদের মারধর করা হয়েছিল, কীভাবে স্বামীকে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং তাদের (ব্রিটিশদের) বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য রাখা হতো। আমরা যেন তাদের কখনো ভুলে না যাই। তারা আমাদের নায়ক।’
রানির মৃত্যুতে আফ্রিকার এই মানুষদের শোক প্রকাশে অনীহা এটাই দেখাচ্ছে, বিশ্বের কোনো অংশ রানি এলিজাবেথ ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও আফ্রিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আমলে তিনি নিপীড়নের প্রতীক ছিলেন।
১৮৯৫ সাল থেকে কেনিয়া ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। ১৯২০ সালে সরকারিভাবে একে ব্রিটিশ উপনিবেশের আওতায় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালে স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই ছিল কেনিয়া। ১৯৫২ সালে রানি এলিজাবেথ যখন সিংহাসনে বসেন তখন কেনিয়ায় মাউ মাউ বিদ্রোহ হয়েছিল। আর ওই সময় স্থানীয়দের ওপর ভয়ঙ্কর নৃশংসতা চালিয়েছিল ব্রিটিশরা। প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার কেনীয়কে বন্দি করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। এসব কেনীয়কে যৌন নিপীড়নসহ চরম নির্যাতন সইতে হয়েছিল।
কেনেসো স্টেট ইউনিভার্সিটির যোগাযোগ বিষয়ক অধ্যাপক ফারুক কেপেরোগি সিএনএনকে বলেছেন, রানিকে নিয়ে আফ্রিকার স্মৃতি সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে পৃথক করা যায় না।
তিনি বলেন, ‘রানির সিংহাসনে আরোহন ঔপনিবেশিকতায় শুরু হয়েছিল এবং এখনও এটির মধ্যে আবৃত রয়েছে। বলা হতো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায় না। তার মৃত্যু যে পরিমাণ শোক বা সহানুভূতি তৈরি করেছে তা অতীত মুছে ফেলতে পারে না।’
আফ্রিকা অঞ্চলের আরেক দেশ নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। ওই সময় বিদ্রোহী বিয়াফ্রানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য সরকারকে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল ব্রিটিশরা। ওই যুদ্ধে ১০ থেকে ৩০ লাখ নাইজেরীয় নিহত হয়। যুদ্ধে নিজের দেশের ভূমিকার প্রতিবাদে ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী জন লেনন তার ম্মানসূচক উপাধি এমবিই রানিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ব্রিটেনের অতীতের অপরাধের প্রতিক্রিয়ায় আফ্রিকার কয়েকটি দেশ সরব হচ্ছে । বার্বাডোস ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার ৫৫ বছর পরে ২০২১ সালের নভেম্বরে রানি এলিজাবেথকে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ করেছে। জ্যামাইকার মতো অন্যান্য ক্যারিবিয়ান দেশগুলি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা একই পদক্ষেপ নিতে চায়।
ব্রিটিশ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়াম এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন মার্চ মাসে জ্যামাইকা সফর করেছিলেন। ওই সময় তাদের এই সফরের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছিল। দাসত্বের সাথে রাজপরিবারের সংশ্লিষ্টতার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছিল।
অ্যাডভোকেটস নেটওয়ার্ক জ্যামাইকা নামের একটি সংগঠন লিখেছিল, ‘সিংহাসনে আপনার দাদীর ৭০ বছর চলাকালেও তিনি আমাদের পূর্বপুরুষদের দুর্দশার প্রতিকার এবং প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য কিছুই করেননি। আফ্রিকানদের পাচার, দাস বানানো, উপনিবেশবাদ তার শাসনামলে পুরো সময়কালে ঘটেছিল।’