মালদ্বীপকে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশটির সরকারি ও বেসরকারি খাতকে পারস্পরিক সুবিধার জন্য তিনি উন্নয়ন অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানান।
বৃহস্পতিবার মালদ্বীপের পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি বলেন, আমি আশা করি আমাদের দুই দেশের উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুসংহত হবে।
বিশ্বের কোনো দেশ বিচ্ছিন্নভাবে উন্নতি করতে পারে না উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি সবাইকে শিখিয়েছে যে-আমরা পরস্পর নির্ভরশীল এবং একটি উন্নত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বিশ্বের স্বার্থে আমাদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতিগত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি, যেমনটি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন। মালদ্বীপের পার্লামেন্ট ‘পিপলস মজলিসে’ শেখ হাসিনা বলেন, আপনাদের উন্নয়নের যাত্রা, এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে আপনাদের সফল উত্তরণ প্রত্যক্ষ করে আমরা বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছি এবং আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ পরিপূরকগুলোকে কাজে লাগাবে।
তিনি বলেন, এ সুন্দর দেশের গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র, রাজনীতি ও নীতির এ আবাসস্থলে মজলিসের বিশিষ্ট সদস্যদের মাঝে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি গভীরভাবে সম্মানিত। একটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের পার্লামেন্টে উপস্থিত হতে পেরে আমি আনন্দিত। তিনি আরও বলেন, মালদ্বীপের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক যোগসূত্র, বহুবিধ মিল, একই ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সমৃদ্ধির একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করে থাকি।
২০২১ সালটি বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি যুগান্তকারী বছর উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যেখানে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে ফলপ্রসূ দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে।
আশা করি দুই দেশের আগামী ৫০ বছরের যাত্রা আরও ফলপ্রসূ হবে এবং জনগণের জীবনে অর্থবহ পরিবর্তন আনবে। তিনি বলেন, আমি মালদ্বীপের জনগণ এবং এর অগ্রগামী নেতাদের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।
ভাষণে তিনি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। যিনি তার (বঙ্গবন্ধু) সারাজীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত শোষণ, বঞ্চনাহীন সমাজ বিনির্মাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন। মার্চে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ যোগদান করায় তাকে শেখ হাসিনা ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ সহজ ছিল না। জাতির পিতা বাংলার মানুষের সুখের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তিনি প্রায় ১৩ বছর জেলে কাটিয়েছেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে আসার পর তার জনগণের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ শুরু করে মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সদ্যোজাত দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমি ও আমার ছোট বোন (শেখ রেহানা) সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই এবং পরবর্তীকালে ছয় বছর প্রবাস জীবনে থাকতে বাধ্য হই। বাংলাদেশে ফিরে এসেও কারাবাস, একাধিক গুপ্তহত্যার চেষ্টা এবং অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এটা আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি যে আজ বাংলাদেশ গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশংসা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশের আর্থ-সামাজিক মুক্তির পথের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং এ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, আমি ভাগ করে নিতে পেরে আনন্দিত যে, বাংলাদেশ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আগের কয়েক বছরে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি ছিল, মহামারির ঠিক আগে, আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। তিনি বলেন, আর্থ-সামাজিক সূচক বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশুর স্বাস্থ্য, আয়ুষ্কাল, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, স্যানিটেশন, পানীয় জল, প্রাথমিক শিক্ষা এবং সাক্ষরতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গত এক দশকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উন্নয়ন যাত্রার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা হয়েছে। এরপর এখন লক্ষ্য হলো-২০৩১ সালের মধ্যে এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে পরিণত করা। তিনি আরও বলেন, ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিস্থাপক ডেল্টায় পরিণত করা।
তিনি বলেন, আপনারা হয়তো অবগত আছেন যে-জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ বছর ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ৪১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এবং বিশ্বের ৩৪টি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।’
উন্নয়ন তার নিজস্ব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এলডিসি হিসাবে আমরা যে সুবিধাগুলো উপভোগ করতাম তা প্রত্যাহারের পর আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হব তা মোকাবিলা করার জন্য, আমাদের ফোকাস হবে অর্থনীতির বৈচিত্র্যকরণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের দিকে। তিনি বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে একটি প্রযুক্তিচালিত সমাজ এবং উদ্ভাবন-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধিতে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
মালদ্বীপের পার্লামেন্ট ‘পিপলস মজলিসে’ শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান দেশটির স্পিকার মোহাম্মদ নাশিদ। স্পিকারের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন এবং সেখানকার দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
মালদ্বীপের পার্লামেন্টের স্পিকার তার বক্তৃতায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশের নেতৃত্বদানে শেখ হাসিনার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ইস্যুগুলোতে সম্মত করাতে শেখ হাসিনাকে পাঁচ চুক্তি প্রণেতার অন্যতম হিসাবে বিবিসি রিপোর্টের কথাও উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্পিকার একটি নৌকার চিত্রকর্ম উপহার দেন।