ইসলাম আসার আগের সময়কে ঐতিহাসিকরা অন্ধকার-বর্বর যুগ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তখন মানুষকে মানুষ মনে করা হতো না। দুর্বল-দরিদ্র শ্রেণি ছিল ধনী-শক্তিশালীদের হাতের পুতুল। নারীরা বিক্রি হতো হাটে-বাজারে। এমন অন্ধকারের বুক চিরে আলো হাতে এসেছেন প্রিয় নবিজি (সা.)। শুধু আরব নয়, জগৎ আলোকিত হয়েছে তার অনুপম আদর্শ আর খোদায়ী কর্মপরিকল্পনার নুরে। তিনি বিশ্ববাসীকে শিখিয়েছেন মানবাধিকার সম্পর্কে। আধুনিক বিশ্বে যত মানবাধিকার সংগঠন আছে সবাই নবিজির মানবাধিকার নীতির কাছে চির ঋণী। নবিজির দেওয়া মানবাধিকার নীতির মধ্যে সবার আগে গুরুত্ব পেয়েছেন ‘হিফজুন নফস’ বা বাঁচার অধিকার। অন্যায়ভাবে কোনো মানুষের বাঁচার অধিকারে হস্তক্ষেপ করার অনুমতি ইসলাম কাউকে দেয়নি। বরং কেউ যদি নিরপরাধ মানুষের জীবন সংকুচিত করে ফেলে বা তাকে আঘাত করে কিংবা ঘটনাক্রমে তাকে হত্যাও করে ফেলে, তাহলে ইসলামী সরকারের প্রথম কর্তব্য হলো ওই অপরাধীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
সব আসমানি ধর্মেই মানব হত্যা জঘন্য অপরাধ হিসাবে আখ্যা পেয়েছে। বলা ভালো, নিরীহ মানুষকে অহেতুক মেরে ফেলার চেয়ে ভয়াবহ পাপ পৃথিবীতে আর নেই। ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী হলো, ‘মানবহত্যা মহাপাপ’। বাঁচার অধিকারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা মানে হলো পুরো মানবজাতিকে মেরে ফেলা। অন্যদিকে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা মানে হলো পুরো মানব জাতির জীবন রক্ষা করা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি বনি ইসরাইলের ওপর বিধান নাজিল করেছিলাম যে, যখন কেউ কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যখন কেউ কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করল।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত ৩২।) শুধু তাই নয় যে মানুষ এখনো দুনিয়ায় আসেনি, যার দেহে এখনো প্রাণ ফুঁকেনি আল্লাহতায়ালা তার বাঁচার অধিকার নিয়েও স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন কুরআনে। আজকাল অনেকেই ভ্রূণ হত্যা করে ফেলে কিংবা দারিদ্র্যের ভয়ে নবজাতক শিশু মেরে ফেলে। এগুলো গুরুতর অপরাধ চিহ্নিত করে আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমি তাদের ও তোমাদের রিজিক দেব’। (সূরা আনআম, আয়াত ১৫১।)
ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া মানুষ হত্যা কবিরা গুনাহ বলেছেন নবিজি (সা.)। শুধু তাই নয়, হত্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি যাতে না হয় এ জন্য তিনি মারামারি ও সশস্ত্র ঝগড়া-বিবাদ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন বিশ্ববাসীকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক না করে। কারণ সে জানে না, হয়তো শয়তান তার হাত থেকে তা বের করে দিতে পারে, ফলে সে বিনা কারণে মানুষ হত্যা করে জাহান্নামের গর্তে পড়ে যাবে।’ (বুখারি।) অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) স্পষ্ট করে বলেছেন, মুসলমানদের কোনোভাবেই মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত হওয়া জায়েজ নেই। এতে দুপক্ষই জাহান্নামে যাবে। নবিজি (সা.) বলেন, ‘দুজন মুসলমান তরবারি নিয়ে মারামারি করলে একজন মারা যায় এবং অন্যজন জীবিত থাকে। খুব ভালো করে জেনে রাখ! হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর নবি! হত্যকারী জাহান্নামে যাবে এটা তো বুঝলাম কিন্তু নিহত ব্যক্তির জাহান্নামি হওয়ার কারণ কী? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেননা সে তো প্রতিপক্ষকে হত্যা করার জন্যই লড়াইয়ে নেমেছে। সুযোগ পেলে সেও তো হত্যা করত।’ (বুখারি।)
অন্যায়ভাবে কেউ কাউকে হত্যা করলে ইসলামের দৃষ্টিতে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এ শাস্তি হত্যাকারীকে দুনিয়ায় পেতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসী! খুনের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেওয়া হয়েছে। খুনি স্বাধীন ব্যক্তি হলে তার কাছ থেকে, ক্রীতদাস হলে তার কাছ থেকে, নারী হলে তার কাছ থেকে অর্থাৎ যে-ই খুনি হোক, খুনের কিসাস বা বদলা হিসাবে তাকেই হত্যা করা হবে। তবে খুনির প্রতি নিহতের ভাই বা আত্মীয়রা যদি কিছুটা সদয় হয়, তাহলে প্রচলিত ন্যায়নীতি অনুযায়ী খুনের প্রতিবিধান হওয়া উচিত। এবং নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে রক্তপণ পরিশোধ করা হত্যাকারীর অবশ্য কর্তব্য। এ তো তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে দণ্ড হ্রাস ও অনুগ্রহ মাত্র। এরপরও যে বাড়াবাড়ি করবে, তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত ১৭৮।) দুনিয়ার কিসাসের শাস্তির পাশাপাশি পরকালে রয়েছে আরও কঠিন শাস্তি। আল্লাহ বলেন, ‘আর ইচ্ছাকৃতভাবে জেনেশুনে কোনো বিশ্বাসীকে হত্যা করলে তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে থাকবে চিরকাল। আল্লাহর লানত তার ওপর, আল্লাহ তার জন্য কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৯৩।) হত্যার জঘন্যতা ও হত্যাকারীর জন্য কঠোর শাস্তির কথা হাদিস শরিফেও উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি।) হাদিস শরিফে নবিজি (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন হত্যার বিচার করা হবে সবার আগে। তারপর অন্যান্য অপরাধের বিচার করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম।)