এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার অবৈধ দখল এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের কার্যকর দখলের মধ্য দিয়েই মূলত এ আগ্রাসন শুরু হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণের শব্দে জেগে উঠে পুরো ইউক্রেন।
প্রথম রাতেই তারা উৎক্ষেপণ করেছিল ১০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র। পেন্টাগনের মতে, গত তিন সপ্তাহে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের সংখ্য ৯০০ ছাড়িয়েছে।
সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে জনগণকে সতর্ক করা হয়েছে-ইউক্রেনের এমন প্রস্তুতি রাশিয়ানদের জন্য কল্পনাতীত। তারা অনুমান করেছিল প্রথম ঘণ্টার মধ্যেই পুরো আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করবে। কিন্তু সেটা তারা পারেনি। পেন্টাগনের মতে, যুদ্ধের তিন সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেন তার আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষমতার ৮০ শতাংশেরও বেশি ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে।
ইউক্রেনীয়দের টিকে থাকার আরেকটি কারণ সম্পর্কে ধারণা করতে পারেনি রাশিয়া বা পশ্চিমের কেউই। আর তা হলো, ইউক্রেনীয় জনগণের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া যুদ্ধংদেহি মনোভাব। প্রথমে, ইউক্রেনকে ৯৬ ঘণ্টা, তারপর প্রায় ৭ থেকে ১০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল লোকদের ইউক্রেন ছাড়তে। আমরা তা করিনি।
যাই হোক, আমরা ইতোমধ্যে তিন সপ্তাহ ধরে লড়াই করেছি। ১ লাখেরও বেশি মানুষ আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ২০১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুদ্ধে অভিজ্ঞ লোকের সংখ্যা ৩ লাখের বেশি।
এবারের যুদ্ধে সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো-ইউক্রেনীয়দের একতা, ঐক্যবদ্ধতা। অনেক লোক স্বেচ্ছায় সাহায্য করে-এদের মধ্যে ডিজাইনার, জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং আইটি কর্মীরা এখন ছদ্মবেশ জাল বুনছেন, অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছেন, সৈন্যদের জন্য খাবার রান্না করছেন, মোলোটভ ককটেল বানাচ্ছেন, রাশিয়ান ওয়েবসাইটগুলোয় সাইবার আক্রমণ চালাচ্ছেন। যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন।
রাশিয়ানরা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ইউক্রেনের নাগরিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে ইউক্রেনীয়দের মুক্তিদাতা হিসাবে রুশদের স্বাগত জানানো উচিত। আসলে তারা তা নয়-এটা বুঝতে পেরেই রাশিয়ান আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। রুশ সেনাদের অস্ত্রের সামনেই বুক চিতিয়ে প্রতিবাদ করছেন তারা।
অবশ্যই ইউক্রেনের সাফল্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক পশ্চিমা ঐক্য। নিষেধাজ্ঞার পরিমাণ নজিরবিহীন। ব্লুমবার্গের মতে, রাশিয়া এখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। তাদের স্টক মার্কেট বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বাজারে শেয়ারের ক্রমপতন বজায় থাকলে সেটি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে। আসলে নিজেদের নিয়ে সাফল্যের গালগল্প করতে বা শুনতে ভালোই লাগে।
কিন্তু আমাদেরও খারাপ দিক আছে। কিছু দুর্বলতা আছে। রাশিয়াকে আকাশপথে আটকাতে হলে অন্যদের সাহায্য প্রয়োজন ইউক্রেনের। রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক অবকাঠামোগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে হামলা চালাচ্ছে। কয়েক ডজন হাসপাতাল, স্কুল এবং বসবাসের বাড়িঘর ধ্বংস করেছে তারা।
ইউক্রেনের কাছে এত বেশি ফাইটার জেট কিংবা হেলিকপ্টার নেই। এমনকি দুর্বল এন্টি-এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দরুন রাশিয়ানদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের স্থাপনাগুলোয় বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মক ধ্বংস ডেকে আনছে।
রাশিয়ান সেনাবাহিনীর যোদ্ধা সংখ্যাও অনেক বেশি। ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রবল সাহসিকতা সত্ত্বেও ক্ষতি করার দিক থেকে শত্রুরা আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। যদিও ইউক্রেনীয় সেনারা এই তিন সপ্তাহে ১৩ হাজার ৫শর বেশি শত্রুসেনাকে হত্যা করেছে, আরও খবর এলে বদলে যাবে এ পরিসংখ্যানও।
রাশিয়া তার সৈন্য আনা, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান চালানোর জন্য বেলারুশের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে। এমনকি বেলারুশের সেনার এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
রাশিয়ানরা মারাত্মকভাবে যুদ্ধাপরাধে জড়িয়েছে। তারা আমাদের বেসামরিক লোকদের হত্যা করেছে। অবরুদ্ধ শহরগুলো থেকে পালানোর চেষ্টা করছে নাগরিকরা। রুশরা আমাদের বেসামরিকদের জিম্মি করায় কয়েকটি শহরে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তারা দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও দখল করেছে। শুধু তাই নয়, পারমাণবিক বিপর্যয়ের হুমকিতে ফেলেছে পুরো মহাদেশকে।
এই যুদ্ধের ফলাফল এখনো আমাদের জানা নেই। রাশিয়াকে দমাতে হলে আরও নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। তাদের জিঘাংসার শিকার হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে মারা গেছে প্রায় একশ শিশু, আহত হয়েছেন শতাধিক। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৩০ লাখের বেশি মানুষ। এই বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু। ইউক্রেনীয়দের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে বিশ্বের ঐক্য ও কর্মের ওপর, ঠিক যতটা নির্ভর করছে ইউক্রেনের সেনা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সাহসিকতার ওপর।
আপনি যদি ইউক্রেনকে সাহায্য করতে চান, অনুগ্রহ করে মানবিক তহবিল সংগ্রহ করে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে দান করুন। আপনার এমপিদের কাছে যান এবং আপনার রাজনীতিকদের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান, ইউক্রেনের আকাশ বন্ধ করার দাবি জানান, রাশিয়াকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন করুন। মোটের ওপর আমি নিশ্চিত, ইউক্রেন জিতবে। প্রশ্ন হচ্ছে-সেটা কত সময়ে কিংবা কত মূল্য দিতে হবে ইউক্রেনকে। এটা স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সভ্য বিশ্বের যুদ্ধ। আমাদের এই যুদ্ধে জয়ের জন্য সাহায্য করুন। আমরাই জিতব।