নিহত স্বজনদের পাশে বসে ফিলিস্তিনি এক নারী আর্তনাদ করে বলছিলেন, ‘আমি আর কার জন্য কাঁদব… আমার ছেলে…? আমার মেয়ে…? আমার নাতি…? আমার ভাই-বোন…? সবাই তো চলে গেল, আমার আর কেউ রইল না।’ গণমাধ্যম আলজাজিরার প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি বহুতল বাড়ি থেকে কম্বলে মুড়িয়ে বের করা হচ্ছে মরদেহ।
ঘটনা ইসরাইলি বর্বরতার শিকার ফিলিস্তিনির গাজা উপত্যকার। গভীর রাতে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় নেওয়া এক বহুতল বাড়ি বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। বিমান থেকে ফেলা সে বোমায় ঘুমিয়ে থাকা ২৫ শিশুসহ অন্তত ১০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় সময় সোমবার গভীর রাতে গাজার দক্ষিণাঞ্চলের বেইত লাহিয়া শহরের ওই পাঁচ তলা বাড়িটির ওপর হামলে পড়ে ইসরাইলি হানাদাররা। শহরটিতে গত ২৪ দিন ধরেই নৃশংসতা চালাচ্ছে ইহুদি সেনারা। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের বরাতে সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, দেড় শতাধিক মানুষ আহত এবং প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।
বাড়িটি ছিল আবু নাসের পরিবারের। উত্তর গাজা থেকে ইসরাইলি সেনাদের দ্বারা বিতাড়িত ঘর-বাড়িহারা মানুষগুলো আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে। গভীর রাতে যখন ইসরাইল বোমা হামলা শুরু করে তখন বাড়িটিতে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন। স্থানীয় মিডিয়াগুলো জানিয়েছে, ইসরাইলি সেনারা স্বাস্থ্য পরিষেবার সব পর্যায়ে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যে, হাসপাতালগুলোতে আর পর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণও নেই। এসবের অভাবে আহত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েও চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। যেমনটা বলছেন সেখানকার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের পরিচালক ডা. হুসাম আবু সাফিয়া। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, আমরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণের অভাবে বেইত লাহিয়া হত্যাকাণ্ডে আহতদের চিকিৎসাও করতে পারছি না। আহতদের অধিকাংশের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, চিকিৎসা উপকরণের অভাবে তারা মারা যেতে পারে।
মিডল ইস্ট আই লিখেছে, গত সপ্তাহে ইসরাইলি সেনারা অভিযান চালানোর আগে উত্তর গাজার একমাত্র সচল হাসপাতাল ছিল কামাল আদওয়ান হাসপাতালটি। ওইদিন পরিচালক আবু সাফিয়া এবং আরেকজন শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া বাকি সব কর্মীকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছিল ইহুদি হানাদাররা। তার আগেই বারবার হামলা, জ্বালানি, খাবার এবং ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে অন্যান্য হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় তারা।
আবু সাফিয়া বলেন, যারা আহতদের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিল তারাও ইসরাইলি বোমায় ক্ষতবিক্ষত ছিল। বিশ্বকে কেবল গাজার গণহত্যা চেয়ে চেয়ে না দেখে অবশ্যই প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত।
গেল ৫ অক্টোবর থেকে ইসরাইলি বাহিনী গাজায় নতুন মাত্রায় নৃশংসতা শুরু করেছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এই নৃশংসতাকে ফিলিস্তিনি এলাকায় জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। এই নৃশংসতা ইসরাইলি সরকারের বিতর্কিত এক প্রস্তাব ‘জেনারেলদের পরিকল্পনা’ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো উত্তর গাজা খালি করে সেখানে একটি মিলিটারি জোন প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রস্তাবের নেতৃত্বে থাকা জিওরা আইল্যান্ড নামে এক অবসরে যাওয়া জেনারেল জানান, যারা এলাকা ছেড়ে চলে যাবে তারা খাবার এবং পানি পাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী যারা এলাকা ছাড়বে না তাদেরকে হামাস অপারেটিভ হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হবে। ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিএ গাজা শহরসহ উত্তর গাজায় চার লাখেরও বেশি মানুষ আটকে পড়েছেন। ওসব এলাকায় কঠোর অবরোধ আর মিডিয়া ব্লাকআউটের মধ্যে রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। জাতিগত নিধনে ইহুদি হানাদাররা বেছে নিয়েছে ক্ষুধা এবং অপুষ্টিকে।
১৩ মাস আগে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। তাদের বর্বরতায় আহত হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন যারা সম্ভবত ধ্বংসস্তূপের নিচে মরে পড়ে রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ১৭ হাজার শিশু এবং ১২ হাজার নারীও রয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস।