দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে ফের নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। বরাবরের মতো এবারও তিনি নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন।
পাশাপাশি নির্বাচন ঘিরে বেশ কিছু আশঙ্কাও ঘিরে ধরেছে তাকে। শামীম ধারণা করছেন আগামী ১৫ দিন কিছু নির্মম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের চেষ্টা হবে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব ভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন শামীম ওসমান। সেখানেই তিনি তার আশঙ্কার কথা জানান।
শামীম বলেন, নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মধুর হবে। শেখ হাসিনাকে টলানো এত সহজ না। জাতির পিতার সাথে তার কন্যার একটা ডিফারেন্স আছে। জাতির পিতা সবাইকে বিশ্বাস করতেন সেই সুযোগ নিত বিশ্বাসঘাতকরা, জাতির পিতার কন্যা বিশ্বাসঘাতকদের চিনে রেখেছেন। তার ওপর আল্লাহর রহমত আছে। গত দুই বছর ধরে শুনছি সরকার পড়ে যাবে; ক্ষমতায় আসছি এসব কিচ্ছু হবে না। নির্বাচন হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে।
এ সময় বিদেশিদের দরজায় জোরে লাথি দেওয়ার কথা বলেন এ সংসদ সদস্য। তিনি বলেন, ১০০ পার্সেন্ট ফেয়ার নির্বাচন হবে। কেউ ঘাড়ও ঘোরাতে পারবে না। যারা নকল করে পাস করে তাদের জন্য নয়, তবে আমাদের জন্য এটা সুখবর। আমরা যারা সারা বছর রাজপথে থাকি, পড়ালেখা করি। আমরা চাই রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকুক।
এ সময় আগামী কয়েকদিনে দেশে সহিংসতার চেষ্টা করা হবে বলে নিজের ধারণার কথা বলে শামীম ওসমান। তিনি বলেন, সামনে আর কয়টা দিন। আগামী ১৫/২০ দিন দেশব্যাপী সহিংসতার চেষ্টা করা হবে। যারা করাবে তারা কিন্তু আড়ালেই থাকবে। যারা করবে তারা ফেঁসে যাবে। আমাদের এলাকার পাগলদেরও আমরা চিনি। আমি যদি বলি পাঁচ মিনিটে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা হবে। তখন দোষ কার হবে, আমার হবে। যারা বাইরে থেকে নির্দেশ পেয়ে অরাজকতা করছে তারা কিন্তু ছাড় পাবে না। এবার ক্ষমতায় আসলে দুটি জিনিস ছাড় দেওয়া হবে না। একটা মানি লন্ডারিং আর আরেকটা দুর্নীতি।
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের এ কাণ্ডারি বলেন, আমি একটা মেসেজ দিতে চাই। এত উন্নয়ন হয়েছে, এ রাস্তা দিয়ে কী শুধু আওয়ামী লীগ চলবে? বিএনপির ছেলেরাও চলাফেরা করবে, জামায়াতের ছেলেরা চলবে। এই রাস্তার পাশে বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হবে, মেডিকেল কলেজ হবে। তার পাশে শেখ কামাল আইটি ইনস্টিটিউট হবে। কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি শুধু ফতুল্লা এলাকায় ছয়শ কোটি টাকার রাস্তা করেছি। আমরা ৫৮টি বড় বড় বিল্ডিং করে দিয়েছি স্কুলের৷
এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ও মায়ের খবরই রাখে না, কর্মীদের খবর কী রাখবে?
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের একজন এমপি ছিলেন। এক সময় জাতীয় পার্টি করতেন, তারপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি আবারও আওয়ামী লীগ হয়ে বিএনপিতে। এখন নাকি নতুন দলে ভিড়তে চাচ্ছে। তৃণমূলে, বিএনএফে নক করছেন এখন। এত বড় পল্টিবাজ, তাই তাকে আর কেউ নিতে চাচ্ছে না। তার আমলে আমাদের সুন্দর আলী ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বিএনপির তৈমূর সাহেবের ছোট ভাই, কোনো দল করত না। মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের বারো জন লোককে মারা হয়েছে। যারা মানবাধিকারের কথা বলে, আমাদের নজরুল ইসলাম সুইটকে জেলখানা থেকে রিমান্ডের নাম করে নিয়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এর চেয়ে বড় আইনের ধর্ষক হতে পারে না। এখন উনি নতুন নাটক করছেন। মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন কি দেন নাই, আমার ব্যাপার না। মনোনয়নপত্র জমা না হওয়া পর্যন্ত তা বাতিল করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এটা স্ট্যান্ডবাজি হচ্ছে।
শামীম ওসমান আরও বলেন, ২০০৮ সাল থেকে আমরা ক্ষমতায়। আমি ২০১৪ সালে এমপি হয়েছি। জাতির পিতার কন্যা বলেছে কোনো প্রতিহিংসা নয়। শয়তানের কাজ শয়তানি করা। আমরা ওদের মতো হবো না। কষ্ট হয়েছে, বুকে পাথর চাপা দেওয়া আছে।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে জঙ্গিবাদ ছিল না যখন তৈমূর ভাই, সিরাজ ভাই ও কালাম ভাইরা দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আমি পাশ করার পর বিএনপির সদ্য সাবেক সাংসদ সিরাজ ভাইকে সালাম করেছি। এটা ছিল নারায়ণগঞ্জের কালচার। সে সময় কোনো সহিংসতা হয়নি। আমরা চেয়েছি সহবস্থানে থাকতে। কিন্তু হঠাৎ নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে চেঞ্জ আসে। ডিজিটাল যুগে দেশে আঠারো কোটি ক্যামেরা আছে। রাজনীতির নামে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নারায়ণগঞ্জে কোথায় ছিল আমরা জানতাম। দেখতে চেয়েছিলাম শুধু কী করে। এই ভদ্রলোক (গিয়াসউদ্দিন) সভাপতি হওয়ার পর কাঁচপুরে ঘটনা ঘটিয়ে ওরা আড়াইহাজার যায়। সেখানে এক পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে মারতে দেখা গেল। পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হতেই পারে। কিন্তু আমরা কি পশু হয়ে গেলাম? ঢাকায় একজন পুলিশকে নির্মমভাবে কোপানো হলো। এগুলো দেখেছি আমরা।
২০০১ থেকে ২০০৬ আমরা ক্ষমতায় ছিলাম না। সে নির্বাচনে আমাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হল পরে সেটা বদলে দেওয়া হয়। আপা আমাকে ফোন করে বলল তুমি জিতেছ, আমি বললাম আমাকে হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে রাতে আমাদের বহু লোককে অ্যারেস্ট করা হয়, বন্দরে একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমি ডিসি অফিসে যাই, তখন সেখানে আর্মির একজন লোক এসে আমাকে বলল শামীম ভাই চলে যান, আপনাকে মেরে ফেলা হবে। আমিই সে নির্বাচনের পর প্রথম বলেছিলাম নির্বাচনে আর্মি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল কী অত্যাচার হয়েছে। সে অত্যাচারের মাত্রা কল্পনা করা যায় না। আমার দাদার বাড়ি বায়তুল আমান, যেখানে আওয়ামী লীগ তৈরি হয়েছে। সে বাড়িটা বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হলো। আমাদের বাড়ি হীরা মহল ভাঙা হলো, আগুন দেয়া হলো। আমার বাবা যে চেয়ারে বসতেন সেটায় পেশাব করা হল। আমার বড় ভাই সেলিম ওসমান, তিনি সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করেন। তার বাড়ি ও ফ্যাক্টরিতে হামলা করে তিনশ গরুর দুধের বান কেটে দেওয়া হল। তাকে অস্ত্র দিয়ে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়েছিল। সব মেনে নিয়েছি। যেটা মানতে পারি না সেটা হল আমার বিশজন লোক মারা গেছে বোমা হামলায়। বিএনপির অনেক বড় বড় নেতাকে আসামি করা হয়েছিল। তবে জ্ঞান ফেরার পর আমি বলেছিলাম তারা জড়িত না। কারণ, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মিথ্যা বলব না।
তিনি বলেন, এই সংবাদ সম্মেলন আমি করতাম না, যারা মারা গেছে তাদের দুই চারজনের বাসায় আমি গেছি ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ভাই আপনি কি বিচার করবেন না? নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে কোনো অসভ্যতা ছিল না। যখন তৈমূর আলম খন্দকার, কালাম ভাই ছিলেন এমনকি যখন কমান্ডার সিরাজ ভাই এমপি ছিলেন তখনো এমন ছিল না। নারায়ণগঞ্জে গত ১৪ বছরে কোনো সহিংসতা নেই। নারায়ণগঞ্জ ৪, ৫ আসনে অন্তত কিছু হয়নি। কারণ, আমরা উন্নয়ন করে মানুষকে খুশি করতে চেষ্টা করেছি।
আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাই, আমি মানুষ। যদি কোনো ভুল করে থাকি ক্ষমা করে দেবেন আপনারা। আমি চাই কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন মামলার আসামি না হয়। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যদি এক ঘণ্টার জন্যও শাস্তি পায় সেটা খারাপ। আমি পুলিশ প্রশাসনসহ সকলকে এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে অনুরোধ করি।
শামীম আরও বলেন, আগামী ১৫ দিন কিছু নির্মম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করার চেষ্টা করা হবে। বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে চেষ্টা করা হবে। প্লিজ নারায়ণগঞ্জের ভাইয়েরা এগুলো করবেন না। যা করেছেন, করে ফেলেছেন। আর না। নিরপরাধ কাউকে কিছু করবেন না। কিন্তু যারা অপরাধী তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। যারা আমাকে মারতে চান মারেন সমস্যা নাই, আমাকে একা মারেন। কাপুরুষের মতো বোমা হামলা কইরেন না। এত মানুষ মাইরেন না।
সংবাদ সম্মেলনের শেষে শামীম বলেন, মানিলন্ডারিং দুর্নীতিবাজ এসব ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। এই দুঃসময়ে যারা চালাকি করে বড় বড় জাহাজ গভীর সমুদ্রে রেখে দিয়েছেন ছাড় পাবেন না। দ্রব্যমূল্য কমান না হলে কিছু ছাড় পাবেন না। জনগণকে কষ্ট দেবেন না। কারণ, বাঘে ধরলেও ছাড়ে; শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়বেন না।