মোঃ মামুন হোসেন : জীবনের পথচলায় কিছু সম্পর্ক থাকে যা কখনো পুরনো হয় না—বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেসব সম্পর্ক হৃদয়ের গহীনে অমলিন রয়ে যায়। এমনই এক সম্পর্ক আমাদের, সৈয়দপুর বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯৪ সালের ব্যাচের সহপাঠিদের। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের মধ্যে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যবসায়ী আবার কেউবা প্রবাসী জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তবু আজও যখন দেখা হয় বা কথা হয়, তখন মনে হয়, আমরা সেই ক্লাসরুমেই বসে আছি, হাতে খাতা-কলম, মুখে নিরন্তর হাসি, আর চোখে স্বপ্ন। স্কুলজীবনের স্মৃতি এক অমূল্য সম্পদ। সকালবেলা ইউনিফর্ম পরে বন্ধুদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের পথে যাত্রা, প্রথম ঘণ্টার বেল, শিক্ষকদের উপদেশ, বাগানে ছুটোছুটি, টিফিনের সময় একসাথে খাওয়া, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মাঠে খেলা—সব কিছু আজও চোখ বুজলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব সাধারণ ঘটনা তখন মনে হয়েছিল স্বাভাবিক, কিন্তু এখন বুঝি, সেগুলোই আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো ছিল। ১৯৯৪ সালের সেই দিনগুলো ছিল আমাদের জীবনের এক বিশুদ্ধ, নির্মল অধ্যায়। আমরা একে অপরের আনন্দ, দুঃখ, ব্যর্থতা আর সাফল্যের অংশীদার ছিলাম। পরীক্ষার আগের রাতের উত্তেজনা, কোন শিক্ষকের ভয়, আবার কোন শিক্ষকের অতি স্নেহ, বন্ধুদের মধ্যকার ছোটখাটো অভিমান সব মিলিয়েই ছিল এক অনন্য সময়। আমাদের এই বন্ধুত্ব কেবল তখনকার স্কুল জীবনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই যখন জীবনের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লাম, তখনও আমরা পরস্পরের খোঁজ রেখেছি। আজকের প্রযুক্তির যুগে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের মাঝে সংযোগ রেখেছি—ফোন, মেসেজ, ভিডিও কলে আমরা আবার এক ক্লাসে ফিরে যাই, হৃদয়ের বন্ধনে ফিরে যাই।
বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে, জীবনের দায়িত্ব বাড়ছে, কিন্তু বন্ধুত্বের সেই রঙ একটুও ফিকে হয়নি। বরং সময় যত যাচ্ছে, স্মৃতিগুলো আরও মধুর হয়ে উঠছে। কারো ছেলে-মেয়ের বিয়েতে দেখা হয়, কেউ আবার অসুস্থ হলে সবাই খোঁজ নেয়, কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা এগিয়ে আসে। এমন বন্ধন আর কোথায় পাওয়া যায়? ২০২৫ সালের এই সময়েও আমরা যখন কোনো পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে মিলিত হই, তখন সেই পুরনো হাস্যরস, সেই পুরনো ঠাট্টা, সেই চোখের চাওয়া, বুকভরা আবেগ—সব কিছু এক নিমিষে ফিরে আসে। মনে হয়, বয়স যেন থেমে গেছে, সময় যেন পিছিয়ে গেছে ৩০ বছর। আমরা তখন আবার সেই কিশোর, যারা জীবনের কোন ভয় না পেয়ে স্বপ্ন দেখত একসাথে বড় হওয়ার।
আমাদের এই বন্ধুত্ব নিছক সহপাঠি কিংবা পরিচয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। আমরা আজ একে অপরের পরিবারের অংশ। কেউ যদি কোনো সমস্যায় পড়ে, তাহলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মানুষগুলোর প্রথম সারিতে থাকি আমরা। এই সম্পর্কের মূল শক্তি হলো আন্তরিকতা, ভালোবাসা আর পারস্পরিক সম্মান।এই বন্ধুত্ব আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে জীবনে বিশ্বাস আর সম্পর্ক ধরে রাখতে হয়। আমরা একে অপরকে উৎসাহ দিই, ব্যর্থতা থেকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করি, এবং সাফল্যের সময় একসাথে আনন্দ করি। জীবনের নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মাঝেও আমাদের বন্ধন আজও অটুট, নির্ভরযোগ্য, এবং হৃদয়গ্রাহী।এই বন্ধুত্ব শুধু স্মৃতিময় নয়, এটি আমাদের প্রেরণা। আমাদের জীবনের এই অমূল্য অধ্যায় আমরা কখনো ভুলতে পারি না। আমাদের সন্তানদের কাছেও আমরা এই বন্ধুত্বের গল্প শুনাই—তারা যেন বোঝে, জীবনে শুধু সফলতাই নয়, সম্পর্ক আর বন্ধুত্বই হলো আসল অর্জন। আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি—সৈয়দপুর বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯৪ সালের ব্যাচ শুধুই একটি ব্যাচ নয়, এটি একটি পরিবার।এই পরিবারের প্রতিটি সদস্য আমাদের হৃদয়ে গাঁথা, স্মৃতির পাতায় অমলিন। জীবন যতই ব্যস্ত হয়ে উঠুক, যতই দূরত্ব বাড়ুক, আমাদের এই বন্ধন কখনো ছিন্ন হবে না। আমরা সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে যাব—হৃদয়ের বন্ধনে, ভালোবাসার ছায়ায়, স্মৃতির আলোয়।
এই গল্প শুধু আমাদের নয়, এটি বন্ধুত্বের এক চিরন্তন দলিল।