শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৮ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

সেজানের পোড়া কারখানা থেকে বের হলো ৫২ মরদেহ

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১, ১০.৩৮ পিএম
  • ২৫৬ বার পড়া হয়েছে

রুদ্রবার্তা২৪.নেট: রাতভর জ্বলেছে আগুন। পরদিন দুপুরে কারখানার ভেতর থেকে বের করা হয় প্যাকেটবন্দী ৪৯ জনের মরদেহ। মরদেহগুলো তোলা হচ্ছিলো অ্যাম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়িতে। বাইরে তখনও চলছিল নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারি। ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। শুক্রবার (৯ জুলাই) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার হাশেম ফুডস লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান চত্ত¡রে ছিল এমনই চিত্র।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সজীব গ্রæপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার ছয়তলার একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান কারখানার ৫২ জন শ্রমিক-কর্মচারী। ফায়ার সার্ভিস ও বেঁচে ফেরা শ্রমিকদের দেওয়া তথ্যমতে, ভবনের নিচতলায় প্রথমে আগুন লাগে। নিচতলায় ছিল ফয়েল প্যাকেটসহ বিভিন্ন কার্টন। এসব সহজেই দাহ্য হওয়ার কারণে মুহুর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনের অন্যান্য তলায়। শ্রমিকদের অভিযোগ, আগুন লাগার কিছুণ পরই ভবনের দু’টি দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগেই কিছু শ্রমিক কারখানা থেকে বেরিয়ে যান। আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়লে ভীত-সন্ত্রস্ত শ্রমিকরা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন ভবন থেকে। এই ঘটনায় আহত দুই নারীকে রাতেই পার্শ্ববর্তী ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই মারা যান তারা। পরে গুরুতর আহত আরও এক পুরুষ শ্রমিক মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, ৫টা ৪২ মিনিটে তারা অগ্নিকান্ডের খবর পান। ৩০ মিনিটের মধ্যেই তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এর আগেই আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। রাতেই ২৫ জন শ্রমিককে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছিলেন তারা। দুপুর দেড়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন তারা। অধিকাংশ মরদেহ ছিল ভবনের চতুর্থ তলা। তখনও ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় আগুন জ্বলছিল। সেই আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বিকেল ৫টার পর। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ভবনের চতুর্থ তলার সিড়ির দরজা বন্ধ ছিল। নিচের তলায় আগুন জ্বলছিল। শ্রমিকরা সিড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে পারলে এত প্রাণহানি ঘটতো না বলে মনে করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে সিআইডি ও পুলিশের টিম রয়েছে। জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণক (কন্ট্রোল রুম) খোলা হয়েছে। সেখানে ডিএনএ টেস্ট করে পরিচয় নিশ্চিত করার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সজীব গ্রæপের প্রধান কার্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ্ আজাদ বলেন, তিগ্রস্ত ভবনটির নিচতলায় ছিল কার্টুনের স্টোররুম। সেখানে কাগজের কার্টুন, বোতল তৈরির কাচামাল, ফয়েল কাগজ ছিল। ভবনের দুই থেকে পঞ্চম তলায় টোস্ট, অরেঞ্জ জুস, কোমল পানীয়, লাচ্ছা সেমাই, লাচ্ছি, মটর ভাজা, চানাচুর তৈরি হতো। ষষ্ঠ তলায় ছিল স্টোররুম। তিগ্রস্ত কারখানার এডমিন ইনচার্জ সালাউদ্দিন মিয়া জানান, সেকশনের পাঁচটি ফোরে চারশ’ শ্রমিক বিকালে ওভারটাইম করছিলেন। সে ভবনের উপরের ফোরে তাদের স্টোর। সেখানে কয়েক কোটি টাকার মালামাল রয়েছে।
শ্রমিকরা জানান, নিচতলার একটি অংশে নুডুলস তৈরি করা হতো। দ্বিতীয় তলায় তৈরি হতো টোস্ট। নিচতলা কিংবা দ্বিতীয় তলায় আগুনের সূত্রপাত। তবে নিচতলায় কাগজ ও প্লাস্টিকের কার্টন থাকায় আগুন দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে। উপরে সেমাই ভাজার তেল, ঘিসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থও ছিল।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লে. কর্ণেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কারখানায় প্লাস্টিক, ফয়েল, কাগজ, রেজিন, ঘি, খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের ক্যামিকেলসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ছিল। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগে এবং বেগ পেতে হয়।
আগুন নেভানোর পর সরেজমিনে ঘুরে ও কারখানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৩৪ হাজার স্কয়ার ফুটের ভবনটিতে দু’টি করে সিড়ি, গেট ও লিফট রয়েছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় পার্শ্ববর্তী ভবনের সাথে সংযুক্ত করে এমন একটি গেট রয়েছে। তবে ওই গেট অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে বলে জানান শ্রমিক ও কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা। তবে কারখানা ভবনে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা অপ্রতুল, দুর্যোগকালীন সময়ে প্রবেশ ও বহির্গমন ব্যবস্থাও জোরালো ছিল না বলে প্রাথমিকভাবে নজরে এসেছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্ণেল জিল্লুর রহমান বলেন, ভবনের আয়তন অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা জোরালো ছিল না। ভবনের অবকাঠামোগত বিষয়েও তদন্তের দাবি রাখে বলে জানান তিনি।
শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই কারখানায় শিশু ও কিশোর শ্রমিক কর্মরত ছিল। নিখোঁজ শ্রমিকদের তালিকার মধ্যেও অন্তত দশজন শ্রমিকের বয়স ১৮ বছরের নিচে পাওয়া যায়। শ্রম আইন অনুযায়ী ৮ ঘন্টা কাজের কথা থাকলেও এই কারখানায় শ্রমিকরা টানা ১২ ঘন্টা কাজ করতেন বলে জানান। তবে এই বিষয়ে সজীব গ্রæপের প্রধান নির্বাহী শাহান শাহ্ বলেন, অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বয়স বাড়িয়ে কারখানায় চাকরি নেন। আর ৮ ঘন্টার বাইরে কাজের বেলায় ওভারটাইম হিসাব করা হয় বলে দাবি তার।
নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের ােভ
রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে গেলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় ুব্দ হয়ে উঠছিলেন কারখানায় আটকে পড়া শ্রমিকদের স্বজনরা। সকাল পৌনে এগারোটার দিকে তারা কারখানার অন্যান্য ভবন ও আশেপাশের গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন। তাদের অভিযোগ ছিল, আগুন নেভাতে দেরি করছে ফায়ার সার্ভিস। তাদের কার্যক্রমে গাফিলতি রয়েছে। অন্যদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও ভেতরে আটকা পড়া শ্রমিকদের তথ্য গোপন করছে বলে অভিযোগ ছিল ুব্দ স্বজনদের। তারা স্থানীয় একটি আনসার ক্যাম্পেও হামলা চালায়। সেখান থেকে তিনটি শর্টগান লুট করে পাশ্ববর্তী খালে ফেলে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার সেল ও কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এই ঘটনায় আনসার সদস্যসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এরপর দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ভবন থেকে মরদেহ বের করে আনা শুরু করলে আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠে নিহত শ্রমিকদের স্বজনরা। তাদের সাথে পুলিশের কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। আগের রাতেও মহাসড়কে ভাঙচুর চালান ুব্দ স্বজনরা।
পৃথক তিন তদন্ত কমিটি
অগ্নিকান্ডের কারণ ও ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তর। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে আহবায়ক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক, পুলিশের একজন প্রতিনিধি এবং কলকারখানা অধিদফতরের একজন প্রতিনিধি। জেলা প্রশাসনের প থেকে নিহতদের দাফন ও সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। এদিকে সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। তিনি শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিগ্রস্ত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (রূপগঞ্জ আসন), বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। হতাহত পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।
এর আগে বিকেলে র‌্যাবের মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের কারণ জানতে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদনে কারো গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এদিকে এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2021 rudrabarta24.net
Theme Developed BY ThemesBazar.Com

sakarya bayan escort escort adapazarı Eskişehir escort