প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা থেকে তার জীবন রক্ষা পাওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
তিনি আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ১৭ বছরপূর্তি উপলক্ষে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
‘ফিরে দেখা : ভয়াল ২১ আগস্ট’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে শনিবার (২১ আগস্ট) রাতে সম্প্রচারিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হলো-
প্রশ্ন : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আপনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে এক ডজনের বেশি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয় এবং এ হামলায় আপনি প্রাণে রক্ষা পেলেও দলের ২২ নেতা-কর্মী সেদিন নিহত হন, আহত হন প্রায় ৫০০ মানুষ—এ সম্পর্কে আপনার অনুভূতি ব্যক্ত করুন—
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : দেখুন, বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে একটি সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয়েছিল, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। তখন বাংলা ভাই সৃষ্টি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বোমা হামলা প্রভৃতি ঘটনা ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। যখন সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)–এর মাজারে গ্রেনেড হামলা করা হয় এবং সেই হামলায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আহত হন এবং তিন–চারজন লোক মৃত্যুবরণ করেন। তখন এই হামলা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খুব খারাপভাবে নষ্ট করে। তখনই আমরা সন্ত্রাসবিরোধী একটি র্যালি করার একটি সিদ্ধান্ত নেই এবং যখন সেই র্যালি আমরা করতে চেয়েছিলাম রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে। কিন্তু আমাদের অনুমতি দেওয়া হয় নাই। পরে আমরা প্রস্তুতি নিলাম ঠিক আছে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনেই করব। হঠাৎ তার আগের দিন রাত সাড়ে ১১টায় তারা আবার পারমিশন দেয়। কিন্তু তখন আমাদের মাইক লাগানো হয়ে গেছে, প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন, কাজেই সেখানেই আমরা আমাদের সমাবেশটা করি।
তিনি বলেন, আমি যাই এবং বক্তব্য রাখি এবং বক্তব্য রেখে মাইকটাও হাত থেকে রাখতে পারিনি। এরই মধ্যে বোমার আওয়াজ। শব্দ শুনেই আমাদের নেতা–কর্মীরা আমাকে ধরে বসিয়ে দেয়। বিশেষ করে হানিফ ভাইয়ের (সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) কথা আমি বলব, মামুন—আমার সঙ্গে কাজ করত, নজীব—সে ছুটে আসে, মায়া—তখন ট্রাকের ভেতরেই ছিল। ট্রাকের ভেতরেই সবাই আমাকে একদম ঘিরে রাখে। প্রথমে তিনটা তারপরে তিনটা এভাবে এক ডজনের কাছাকাছি গ্রেনেড তারা ছুড়ে মারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন সত্যি কথা বলতে কি নিজের কথা চিন্তার চেয়েও বেশি চিন্তা হচ্ছিল এতগুলো মানুষ আমরা ট্রাকের ওপরে তারপর চারদিকে আমাদের নেতা-কর্মীরা সবাই। সে সময় কার যে কী অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা পর্যায়ে যখন গ্রেনেড হামলা একটু থামল। তখন দেখলাম সিটি মেয়র হানিফ ভাই, যিনি আমাকে ঘিরে রেখেছিলেন সমস্ত স্প্লিন্টারগুলো তার মাথা এবং গায়ে পড়েছে এবং ওই রক্ত আমার কাপড়ে চলে আসে। সবাই ভেবেছে আমি বোধ হয় আহত, তাই আমাকে ধরে ওঠাতে গেল। আমি বললাম, না, আমার কিছু হয়নি। এটা আমার কাছে একটা বিস্ময় যে আমার গায়ে একটাও স্প্লিন্টার লাগেনি। কিন্তু আমার চশমা হারিয়ে যায়।
তিনি বলেন, সেখান থেকে আমার গাড়িতে ঠিক যখন উঠতে যাব, আমার গাড়ির দরজাটা খুলে দাঁড়িয়েছিল, আমার সাথেই একজন সেনা কর্মকর্তা মাহবুব, ও ছিল আমার ড্রাইভার কাম সিকিউরিটি। ওরা গেটটা খুলে দাঁড়ায় আর ঠিক সে সময়ে সেখানে একটা গুলিও চলে আসে এবং মাহবুব গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই মারা যায়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে সে সময় চলে আসি। পুলিশ সেখানে লাঠিপেটা করে এবং টিয়ার গ্যাস মারে। সেটা আমি আবার পরে জানতে পেরেছি, সে সময় জানতে পারিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো, আমি কখনো মৃত্যুর কথা ভাবিনি। আর আমি জানি মৃত্যু যেকোনো সময় আসতে পারে। সেখানে আমরা সন্ত্রাসের শিকার হলাম। আর অন্য দিন মিটিং করতে গেলে পুলিশের থেকে যে রকম বাধা আসে, তারা ঘেরাও করে রাখে, নেতা-কর্মীদের আসতে বাধা দেয়। সে রকম কোনো প্রস্তুতি নাই। আরেকটা কথা হলো আমাদের পার্টির ভলান্টিয়ার যারা সমাবেশের আগে প্রত্যেকটি ছাদে অবস্থান করে কিন্তু সেদিন কাউকেই ছাদে থাকতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ বাধা দিয়েছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার যে ব্যবস্থাটা নিই, সেটাও তারা করতে দেয়নি।
তিনি বলেন, অনুভূতির কথা আমি এটুকুই বলব, আল্লাহ হয়তো জীবনটা বাঁচিয়ে রেখেছেন, এই ধরনের হামলার শিকার হয়েছি। হয়তো আমার হাত দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের কিছু কল্যাণ করবেন, সে জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তা ছাড়া আরকি!
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন শেখ হাসিনা
প্রশ্ন : এই নৃশংস হামলা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। যেভাবে এর ছক কষা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য এই হামলা করা হয়েছিল। এর কারণ কী?
প্রধানমন্ত্রী : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগঠনটাকে গড়ে তুলেছিলেন এবং এই সংগঠন করবার জন্য তিনি মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান হওয়ার পরেই যেটা উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালির জন্য একটা রাষ্ট্র দরকার, বাঙালি জাতি হিসেবে একটি স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় দরকার। যখনই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিলেন, তাঁকে কিন্তু গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো।
কাজেই তাঁকে হত্যার একটা চেষ্টা তো বহুদিন থেকে ছিল। তার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতির পিতার হাতে গড়া, আওয়ামী লীগকে নিয়েই তিনি বাংলাদেশের মানুষকে সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ করেছেন, প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেছেন।
তিনি বলেন, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল, যারা পাকিস্তানি সরকারের সাপোর্ট করেছে বা পদলেহন করত তারা তো কখনো এ দেশের স্বাধীনতাটাই চায়নি। তাই আওয়ামী লীগের ওপর তাদের ক্ষোভ এই জন্যই যে এই আওয়ামী লীগ সংগঠনটাই তো এ দেশের স্বাধীনতা, আন্দোলন-সংগ্রামে এবং বিজয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং আওয়ামী লীগ প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে সেই সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। পাকিস্তানিরা পরাজিত হয় এবং পরাজয়েই প্রতিশোধ তারা নিতে চেয়েছে সে জন্যই।
প্রশ্ন : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং হামলা–পরবর্তী তাদের আচরণ ছিল অত্যন্ত অমানবিক, বিশেষ করে তখনকার সরকারপ্রধান খালেদা জিয়ার কথাবার্তা, আলামত নষ্ট করা, তদন্তের নামে প্রহসন, জজ মিয়া নাটক ইত্যাদি তাদের এ আচরণকে আপনি কীভাবে আখ্যায়িত করবেন।
প্রধানমন্ত্রী : আমি বলব খালেদা জিয়ার এক একটা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কিন্তু মেসেজ যায়। সে যখন বক্তৃতা দিল আওয়ামী লীগ এক শ বছরেও কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২১ আগস্টের আগে তার বক্তৃতা- শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, বিরোধী দলের নেতাও কোনো দিন হতে পারবে না। এই যে বক্তব্য তার মধ্য থেকেই তো বোঝা যায় তাদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল। আর এর সঙ্গে যে সরকারের সব জড়িত ছিল, তা তো খুব স্পষ্ট। তার (খালেদা জিয়ার) ক্যাবিনেটের মন্ত্রী সালাম পিন্টু সে এর সঙ্গে জড়িত, তখনকার ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের কর্মকর্তারা, পুলিশের কর্মকর্তা তাদের নিয়েই কিন্তু এই চক্রান্তটা করে এবং সব থেকে বড় কথা হচ্ছে তারেক রহমান। সে এই চক্রান্তটা দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করেছে এবং কার্যকরে সব থেকে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। খালেদা জিয়া তো নিশ্চয়ই তার পেছনে ছিল এবং তাকে সমর্থন দিয়েছে।
তিনি বলেন, এখানে আমি একটা কথা বলে রাখি, এই ঘটনার আগে তারেক জিয়া কিন্তু ৫ নম্বর রোডে (ধানমন্ডি) তার শ্বশুরের যে বাড়ি সেখানে অনেক দিন ধরে অবস্থান করেছে, কয়েক মাস। আবার ঠিক ২১ আগস্টের আগে সে ওই বাড়ি ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে চলে যায়। তখন আমার কাছে খবর ছিল এ বাসায় বসে সে একটা কিছু ঘোঁট পাকাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রমনার বটমূলে বোমা হামলা, উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা, এভাবে অনেকগুলো বোমা হামলা, আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর হামলা, এসব হামলা যখন একে একে হচ্ছিল, তারেক জিয়া কিন্তু ওইখানে। হাওয়া ভবনটা ছিল দুর্নীতির আখড়া। আর এই ধরনের যত চক্রান্ত সব সেখানে বসে, শুধু চক্রান্ত করা।
তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলার পরে একটি গ্রেনেড যেটি বিস্ফোরিত হয় নাই। সেই গ্রেনেডটা সেনা অফিসার একজন নিয়ে যায় এবং সে বলল যে এটা রেখে দিতে হবে, এই মামলায় কাজে লাগবে। কিন্তু আমি শুনেছি এই কথা শোনার পর খালেদা জিয়া নিজেই তাকে ধমক দিয়ে বলেছে এটা করা যাবে না এবং সেটা ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
সিটি করপোরেশন থেকে গাড়ি নিয়ে এসে ঘটনাস্থল ধুয়েমুছে সব আলামত সরিয়ে ফেলে। সাধারণত পুলিশ সেখানে যায়, রেড টেপ দেয়, সমস্ত আলামত সংগ্রহ করে, সংরক্ষণ করে। সে রকম কোনো প্রচেষ্টা ছিল না বরং সব আলামত ধ্বংস করে দেওয়ার, মুছে ফেলার চেষ্টা। আর এটা যখন করে, তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যুবলীগের নানক ছিল, আজম ছিল, ছাত্রলীগ–আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বললাম, ওরা এগুলো ধ্বংস করছে তোমরা শিগগির যাও এগুলো সংরক্ষণ করো, চেষ্টা করো।
যেখানে গ্রেনেড পড়েছিল, পরে ওরা সেখানে গিয়ে ওই জায়গাগুলোকে অন্তত চিহ্নিত করে। এরপর তদন্ত কমিশনের নামে একটা তামাশা হলো। মানে একটা তদন্ত কমিশন হলো, সে দেখল কী, পাশের দেশ থেকে এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
সে সময়কার সংসদের ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দলের এতজন এমপি আহত। আইভি রহমান নিহত হয়েছেন। আরও অনেক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। অনেক জন এমপি আহতাবস্থায় চিকিৎসাধীন। আমরা যারা ছিলাম কথা বলতে চেয়েছিলাম, কথা বলতে দেবে না পার্লামেন্টে। আলোচনাই করতে দেবে না।
খালেদা জিয়া তো বলেই বসল ওনাকে আবার কে মারতে যাবে। তার এবং তার নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে উনি তো নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তো ব্যাগ ছাড়াই মঞ্চে উঠেছি। তাহলে গ্রেনেডটা নিলাম কীভাবে।
আর গ্রেনেড মারতে এতটা পারদর্শীই–বা হলাম কীভাবে। আর এটা হলো আর্জেস গ্রেনেড, যেটা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আর এটা পাকিস্তান থেকেই আসা, যেটা তদন্তে পরে বের হয়েছে। কাজেই সবকিছুতেই যে তাদের সম্পৃক্ততা সেটা তো বোঝাই যায় এবং ওই দিন খালেদা জিয়া কোথায় ছিল। খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়া কিন্তু ঢাকায় ছিল না। একজন লক্ষ্মীপুরে আর একজন গোপালগঞ্জে। আর এই ধরনের জঘন্য কাজ। আর দিনের বেলায় একটি রাজনৈতিক দলের জনসভায় প্রকাশ্য হামলা আমার মনে হয় পৃথিবীতে আর হয়নি। যুদ্ধক্ষেত্রে বা রণক্ষেত্রে যা ব্যবহার করে তা তারা ব্যবহার করল সাধারণ মানুষের ওপর, একটা দলের ওপর।
প্রশ্ন : ওই দিন যদি আপনাকে হত্যার মিশন সফল হতো, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা হতো আফগানিস্তানের মতো, মৌলবাদীরা এ দেশ দখল করত। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলার স্বপ্ন অধরাই থেকে যেত, আপনার অভিমত কী?
প্রধানমন্ত্রী: সবাই এটা বিশ্বাস করে। কারণ, ওই সময় খালেদা জিয়ার আমলেই যেভাবে সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়া হয়েছে। রাজশাহীতে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে বাংলা ভাই মিছিল করেছে আর পুলিশ তাদের পাহারা দিচ্ছে, আর বিএনপি নেতারা এদের মদদ দিচ্ছে।
নাটোর, রাজশাহীর বিএনপির বহু নেতা প্রকাশ্যে এদের মদদদানকারী। পরে জঙ্গিবাদ যেভাবে বিস্তার লাভ করে—কিবরিয়া সাহেবের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে তাঁকে হত্যা করা হলো। সুরঞ্জিত সেনের মিটিংয়ে বোমা হামলা হলো, সিলেটে কামরানের মিটিংয়ে আরেকবার বোমা, গ্রেনেড হামলা হলো। শুধু তাই নয়, এভাবে সারা বাংলাদেশে চলছিল। ১৭ আগস্ট একটা দিনে সারা বাংলাদেশের ৫০০ জায়গায় বোমা হামলা হলো। আমাদের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় কিন্তু বোমা হামলা হয়েছে এবং ঢাকা সিটিতে ৩৫ জায়গায় বোমা হামলা হয়। সে সময় আমি টুঙ্গিপাড়ায়। ঠিক ১১টার দিকে আমি একটা ফোন পেলাম দিনাজপুর থেকে আমাদের এক কর্মী ফোন করেছে, আপা, আমাদের এখানে বোমা হামলা হয়েছে। সাথে সাথে আরও কয়েকটা জেলা থেকে বারবার ফোন আসছিল। এমনকি গোপালগঞ্জ জেলা থেকেও ফোন আসছিল, সেখানেও বোমা হামলা হয়েছে। এ কথা শোনার পরেই আমার যদিও দুপুরের পরেই রওনা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমি সাথে সাথেই রওনা হয়ে গেলাম। আমি ঢাকায় চলে আসলাম। আপনাদের একটা জিনিস আমি লক্ষ করতে বলি।
একমাত্র মুন্সিগঞ্জে তখনো কিন্তু বোমা হামলাটা হয় নাই। আমার কিন্তু মুন্সিগঞ্জ থেকেই আসার কথা ছিল। তবে আমি এসেছিলামও মুন্সিগঞ্জ দিয়ে এটা ঠিক। কিন্তু ওরা সময়টা হিসাব করতে পারে নাই। কারণ, আমার রওনা হওয়ার কথা টুঙ্গিপাড়া থেকে বিকেল তিনটা থেকে চারটার দিকে এবং আমি মুন্সিগঞ্জ পৌঁছাতে বিকেল পাঁচটা–ছয়টা বাজবে। কিন্তু আমি রওনা হয়ে গিয়েছি ১১টায়। ওই খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমি সাড়ে ১১টার মধ্যে রওনা হয়ে গিয়েছি। আমাকে অনেকে ফোনে মানা করেছে যে ঢাকার সব জায়গায় বোমা। কোথায় যে বোমা পড়বে ঠিক নাই। আপনি এই সময় মুভ করবেন না, আপনি থাকেন। আমি বলি এই সময় আমাকে ঢাকায় যেতেই হবে।
আমাকে থাকতেই হবে ঢাকায়। কারণ, এতগুলো জেলা থেকে খবর আসছে, একটার পর একটা ফোন আসছে সমস্ত জেলা থেকে। এই সময় তো আমাকে ঢাকায় থাকতেই হবে। ঢাকায় না থাকলে তো আমি কিছু করতে পারব না। আমি সরাসরি রওনা হয়ে চলে আসি। ওটাও যদি কেউ একটু চিন্তা করে যে সব জেলায় হলো ওখানে হলো না। কারণ, নিশ্চয়ই তাদের ওটা একটা প্ল্যান ছিল যে আমি যখন আসব, পার হব তখন ওখানেই হবে, মারবে বা কিছু করবে। কারণ, আমার যে সময় ফেরি ধরার কথা, আমার জন্য তো ফেরি স্পেশাল থাকল, ওটার একটা হিসাব তাদের ছিল। কিন্তু আমি তার আগেই চলে এসেছি। নরমাল যেই রাস্তা দিয়ে আসি, সেভাবে না এসে সোজা বিডিআরের ভেতর দিয়ে আমি সুধা সদনে ঢুকি।
তিনি বলেন, বিএনপি আমলে তো একটা সন্ত্রাসী দেশ করেই ফেলেছিল এবং এতে বহু লোক তালেবানের ট্রেনিং নিয়ে চলে যায় আফগানিস্তানে। সেই মুফতি হান্নান নিজেই তো ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। তারপর এই তাজউদ্দিন, আরেকজন যে সেও তো ট্রেনিং নেওয়া। এ তো সব বিএনপির লোক। তাজউদ্দিন তো বিএনপির খাস এবং গ্রেনেড হামলার পরপর ওই দিন রাত ১১টার সময় চারজনকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে তুলে দেয়। বিশেষ ব্যবস্থায় তারা চলে যায় এবং সেখানে কিন্তু ডালিম আর রশিদও ছিল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার সাথে যে জিয়াউর রহমান জড়িত এবং তার স্ত্রী যে তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে এবং ছেলেকেও সেই একই পথে নামিয়েছে, এটা তো স্পষ্ট।
প্রশ্ন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু ২১ আগস্ট নয়, আপনাকে হত্যার জন্য ২০ থেকে ২২ বার হামলা করা হয়েছে। এই যে এতবার আপনার ওপর হামলা, এত আক্রোশ কেন আপনার ওপর? এরা কারা?
প্রধানমন্ত্রী : আমি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ পা দেওয়ার পর থেকে যেখানেই গেছি, সেখানে তো আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমি যখন খুলনা থেকে রাজশাহী রওনা হলাম, এত মানুষ! মানুষের ঢল সব জায়গায়। কারণ, ১৫ আগস্টের পর মানুষ কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু আমি আসার পরে মনে হলো মানুষের একটা জোয়ার চলে আসল। আমাদের পথে পথে মিটিং করতে করতে আমাদের এত সময় লাগল যে রাত ১১টার দিকে আমি ঈশ্বরদীতে গিয়ে মিটিং করি। যে মিটিং আমার বিকেলে করার কথা। নাটোরে ঢুকব, নাটোরে আমার মিটিংয়ের মঞ্চ ভেঙে দিল, আগুন দিয়ে পোড়াল।
আমাদের নেতা–কর্মীদের ধানখেতে, এখানে সেখানে মেরে ফেলে রেখে দিল। এটা তো আমি যখন আসছি ওই সময়েই। আমি মে মাসে এসেছি, এটা বোধ হয় জুন বা জুলাইয়ের ঘটনা। এইভাবে কিন্তু সব সময় তারা আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্টের পর আমাদের দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। রেহানার পাসপোর্টটা নবায়ন করতে দেয়নি জিয়াউর রহমান। যেহেতু আমি দিল্লিতে ছিলাম, দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন শামসুর রহমান সাহেব, সিএসপি অফিসার। আমাদের পাসপোর্টটা তিনি নবায়ন করে দিয়েছিলেন এবং আমরা যাতে দেশে আসতে না পারি, সেই বাধা ছিল। তারপরে যখন আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে, তখন তো আমি সিদ্ধান্ত নিই চলে আসবই। তারপর স্বাভাবিকভাবে ওই স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী, যে গোষ্ঠীটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে, গণহত্যা করেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে গেছে, মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করিয়েছে, যাদের সমর্থন করেছে—এই শক্তিটাই তো জিয়ার আমলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সংবিধান জাতির পিতা উপহার দিলেন মাত্র ৯ মাসের মধ্যে। সেখানে আমাদের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা—এগুলো তো আমাদের উল্লেখ করা ছিল। কারণ, তখন এসে গেছে মার্শাল ল। মার্শাল ল তো আর গণতন্ত্র না। কাজেই গণতন্ত্রও চলে গেল, ধর্মনিরপেক্ষতাও গেল, সমাজতন্ত্র গেল, সবই গেল।
অর্থনৈতিক মুক্তিটুক্তি সবই বাদ। এই যে পরিবর্তনটা, এটা কাদের খাতিরে করা? কারণ, এরা ওই পরাজিত পাকিস্তানি শক্তি। তাদেরই তোষামোদি খোশামোদি, তাদেরই পদলেহনকারী।
যারা আমাদের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে বাংলাদেশের যে মূল আদর্শ, যে লক্ষ্য—যে গরিবের জন্য কাজ করা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সেটাই তারা করতে চায়নি। বরং ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে একটা এলিট শ্রেণি তৈরি করে তাদের দিয়ে দেশ চালানো বা তাদের নিয়ে ক্ষমতায় থাকা এবং আবার বাংলাদেশ ওই পাকিস্তানি একটা প্রদেশ হয়ে যাক সেটাই ছিল তাদের মানসিকতা।
শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান তো পাকিস্তানি আর্মিতে যোগদান করেছিল এবং তার বাপ–মার কবরও কিন্তু পাকিস্তানে। তারা কিন্তু ইন্ডিয়া থেকে পাকিস্তানেই চলে এসেছিল। তারা কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্বাস করত না। জিয়াউর রহমান কোনো দিন তা বিশ্বাস করেনি, সেটা হলো বাস্তবতা। তার সাথে যারা আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আমরা শাস্তি দিলাম। যাদের শাস্তি শুরু হয়েছিল, জিয়াউর রহমান এসে বিচার বন্ধ করে দেয়। বিচার বন্ধ করে দিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসায়। মন্ত্রী বানায়, উপদেষ্টা বানায়। সেই যুদ্ধাপরাধীরা তাদেরই রাজত্ব হয়ে যায়, তারাই দেশ চালায়। যেই আদর্শ নিয়ে লাখো শহীদ রক্ত দিল, যেই লক্ষ্য নিয়ে সেটা তো সম্পূর্ণ অস্বীকার করল।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পুরো ইতিহাসই তো বিকৃত করা হয়ে গিয়েছিল। আমি আসার পরে স্বাভাবিকভাবে আমি সেই বাস্তবতাটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেই আদর্শটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করে দেশ যেন মর্যাদাপূর্ণ একটা দেশ হয়, সেই চেষ্টা করেছি। আর এদের প্রচেষ্টা কী ছিল যে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এটা যেন কোনো দিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারে। বাংলাদেশ কোনো দিন যেন আর বিশ্বদরবারে মর্যাদা না পায় বা স্বাধীনতা যেন অর্থবহ না হয়। এটাই তো আসল উদ্দেশ্য ছিল। এটাই তো তাদের মূল। সে জন্যই তাদের এই প্রচেষ্টা ছিল।
আর আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে তো বাংলাদেশ আজকে এগিয়ে গেছে। আমরা যদি মাত্র ১২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে একটা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে পারি, তাহলে জাতির পিতা যদি বেঁচে থাকতেন তো ৪০ বছর আগেই আমরা সেটা অর্জন করতে পারতাম। আমি এসে সেই আদর্শ নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু তারা তো সেটা চায়নি। তারা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস করে সেই তালেবান এবং সেই সময় কিন্তু একটা স্লোগানও চলত বাংলাদেশে যে তারা স্লোগান দিত, আমি কোট করছি, ‘আমরা সবাই তালেবান বাংলা হবে আফগান’; আজকে আফগানিস্তানের অবস্থাটা দেখেই তারা দেখুক যে সেখানকার অবস্থাটা কী। সেটাই বাংলাদেশে করতে চেয়েছিল। যেটা হয়তো আমরা আছি বলে পারেনি। এটা আমাদের দেশের মানুষকেও আরও বুঝতে হবে।
বিশেষ করে আমি বলব, আমাদের তরুণ সমাজকে ইতিহাস এবং শিকড়ের সন্ধান করে তাদের সেই আদর্শ নিয়েই চলতে হবে যেন এই লাখো শহীদের রক্ত বৃথা না যায়। আর এ দেশের মানুষের জন্য তো আমার মা-বাবা সবাই জীবন দিয়ে গেছেন। আমার বাবার তো জীবনে কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। তিনি তো যা কিছু করেছেন, এ দেশের মানুষের জন্যই করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, হ্যাঁ, বারবার আঘাত এসেছে। সেই ’৮১ সালে আমি বাংলাদেশে নামার পর থেকেই আমার ওপর হামলা হচ্ছে। আর আল্লাহ আমাকে কীভাবে যেন বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো আল্লাহ তো সবার জন্য কিছু কাজ লিখে দেয়। হয়তো আমার ওপরে এই দায়িত্বটা আছে যে এই বাংলাদেশটাকে যেই মর্যাদাটা হারিয়ে গেছে, সেই মর্যাদাটা ফিরিয়ে দেওয়া। আর এই যে গরিব–দুঃখী মানুষের জন্য, আমার আব্বা যে কাজ করতে চেয়েছিলেন সেটা যেন হয়। এটাই বোধ হয় আল্লাহর ইচ্ছা। আর সেটা যেন আমার হাত দিয়ে হয়। আল্লাহ সেটা চাচ্ছিলেন বলেই বারবার আমাকে হামলা থেকে বাঁচিয়েছেন এবং এই যে আমি যতটুকু সফলতা অর্জন করছি বা যতটুকু বাংলাদেশের জন্য করতে পারছি বা বাংলাদেশের গরিবের জন্য করতে পারছি এটাও আমি মনে করব যে একদিকে আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, অপরদিকে বাংলাদেশের জনগণ এবং ওপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায়। এটাই হলো বাস্তবতা। তা না হলে আমার তো এ দেশে থাকার কথা না।
তিনি বলেন, এখানে খুনিরা অবাধে চলছে। জিয়াউর রহমান তাদের পুরস্কৃত করেছে। তাদের সংসদ সদস্য করা হয়েছে। তাদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। রশিদকে খালেদা জিয়া এমপি বানাল। রশিদ এবং হুদাকে সংসদ সদস্য বানিয়ে নিয়ে আসল। ফারুককে এরশাদ প্রেসিডেনশিয়াল ক্যান্ডিডেট করল। সেই দেশে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকে? এরা তো বাংলাদেশটাকেই জঙ্গিরাষ্ট্র করতে চেয়েছিল।
তিনি বলেন, যা–ই হোক আমি দেশবাসীকে এটা বলব যে তাদের সচেতন থাকতে হবে। আমরা ওই আফগান হতে চাই না। বাংলাদেশ বাংলাদেশই হবে। বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। হ্যাঁ, আল্লাহ যত দিন হায়াত দিয়েছে, তত দিন বেঁচে থাকব। মৃত্যু তো অবধারিত। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীড় হায়রে জীবন নদে’। এটা তো কবি বলে গেছেন। আর সেটাই আমি মনে করি। একবার যখন জন্মেছি, মরতে হবেই। আজকে মরি, কালকে মরি, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ যেদিন জীবন দিয়েছেন, আল্লাহ যেদিন ইচ্ছা জীবন তুলে নেবেন। কাজেই এ নিয়ে আমার কোনো চিন্তা, কোনো দুশ্চিন্তা নাই। আমি একটাই চিন্তা করি, সকালে উঠে ভাবি একটা দিন পেলাম। অন্তত দেশের মানুষের জন্য একটু কাজ করতে পারব। ব্যস, এইটুকুই।
প্রশ্ন : আপনার ওপর এতবার হামলা হলো। এসব হামলা, হুমকি–ধমকিকে আপনি তোয়াক্কা না করে আপনার লক্ষ্য থেকে আপনি বিচ্যুত হননি। এই যে শক্তি, এতটা সাহস, এটা কোত্থেকে পেলেন? এর উৎস কী?
প্রধানমন্ত্রী : এটা আমার আব্বার কাছ থেকে শিখেছি। মার কাছ থেকে শিখেছি। এই দেশের যে মানুষ ক্ষুধার্ত, তাদের ছিন্ন কাপড়, তাদের ঘর নাই, তাদের চিকিৎসা নাই, তাদের শিক্ষা নাই। আমি ’৮১ সালে এসে সারা বাংলাদেশ যখন ঘুরেছি, ওই একই দৃশ্য।
ঠিক যেই দৃশ্য দেখে আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে তো করতে দেওয়া হলো না। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে তিনি যখন দেশটাকে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় কিন্তু ঘাতকের দল হত্যাটা করল। কারণ, তারা দেখল যে এই বাংলাদেশকে আর থামানো যাবে না। তাঁকে শেষ করে দিল অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শেষ করতে পারলেই আটকানো যাবে। ঠিক সেটাই হলো। ২১টা বছর বাংলাদেশের মানুষের কী অবস্থাটা ছিল। কোনো পরিবর্তন তো হয়নি। তারপরে আমরা সরকারে আসার পর থেকে যখন কাজ করেছি, আস্তে আস্তে সেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার জনগণের সেবক, আমরা ঠিক সেই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় পর্যায়ে (ক্ষমতায়) এসে বাংলাদেশকে আমরা অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল করতে পেরেছি এবং আজকে আমাদের লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচন। মুজিব বর্ষ আমরা উদযাপন করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। আমার তো একটাই কথা যে একটা মানুষ গৃহহারা থাকবে না। এখানে শক্তি–সাহসটা হচ্ছে এটা আমার মনের শক্তি, যেটা ছোটবেলা থেকে বাবা–মায়ের কাছে শিক্ষা। আর আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেছি সব সময়। আর বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি বা তাদের যেই সমর্থনটা আমি পেয়েছি। কারণ, বাবা–মা–ভাইবোন সব হারিয়ে যখন একা আসলাম, (’৮১ সালে বাংলাদেশে ফেরার সময়) আমার ছোট দুটো বাচ্চাকে আমি রেহানার কাছে দিয়ে আসলাম। একজন ১০ বছরের, একজন ৮ বছরের। তাদের তো মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করেছি। আমি আসলাম বাংলাদেশের জনগণের জন্য।
তিনি বলেন, আমি বলব যে আমার শক্তি বাংলাদেশের জনগণ। আমার সাহস আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আর শিক্ষা আমার বাবা–মায়ের।
প্রশ্ন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ২১ আগস্ট যারা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারবর্গ বা যারা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের জন্য আপনারা কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন?
প্রধানমন্ত্রী : প্রত্যেকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, যারা মারা গেছে সেই পরিবারকে সাহায্য করা। ধন্যবাদ সেই সময় যারা এগিয়ে এসেছেন, আমাদের ফান্ডে টাকা দিয়েছেন এবং আমরা আলাদা একটা অ্যাকাউন্ট করে সবাইকে সাহায্য করেছি। তা ছাড়া সব চিকিৎসার জন্য দেশে–বিদেশে পাঠিয়ে পাঠিয়ে আমরা সব চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের থেকে আমি তাদের এখন পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য টাকা দিয়ে যাচ্ছি। অনেক পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি। যারা মারা গেছে ঢাকা শহরে তাদের সবাইকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছি। তা ছাড়া যারা নিজের দেশে আছে সে দেশে ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া, তাদের জীবন–জীবিকার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা। সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে পরবর্তীতে যারা আহত ছিল, অনেকেই মারা গেছে। কিন্তু তারপরও তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য যা যা সহযোগিতা করার আমরা করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : আজকে ২১ আগস্টের এই বিয়োগান্ত দিনে দেশবাসীর উদ্দেশে কিছু বলুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী : দেশবাসীকে এটাই বলব আমি যে—হ্যাঁ আমি বেঁচে আছি, ব্যস, এটাই সত্য। আর যতক্ষণ বেঁচে আছি, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাব। কারণ, আমি তো দেশের মানুষের কাছে ওয়াদা দিয়েছি, যেভাবে এই বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমার বাবা–মা জীবন দিয়ে গেছেন, এ দেশের মানুষের জন্য আমি সেভাবে আমার জীবন দিতেও সব সময় প্রস্তুত। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। ওপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, তাকেই ভয় করি এবং তারই দোয়া আর জনগণের সমর্থন।
জনগণের দোয়া নিয়েই আমি চলি। কাজেই আমার এই পথচলায় আমার একটাই লক্ষ্য যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে এই বাংলাদেশকে একটা উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী বাংলাদেশ করব। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেখেছিলেন। সেটাই আমি করতে চাই।
কাজেই, সে ক্ষেত্রে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই, দোয়া চাই এবং সবাই ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন, সেটাই আমি চাই।