‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য। বাঙালির খাদ্য তালিকায় মাঝে মধ্যে মাছ না থাকলেও চলে, তবে ভাত থাকতেই হবে। ভাতের বিকল্প হিসেবে এখনও কোনো খাদ্যদ্রব্য স্থান পায়নি বাঙালির খাদ্য তালিকায়।
ভাত খায় না এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে এমনই এক বিচিত্র মানুষের সন্ধান মিলেছে শরীয়তপুরের নড়িয়াতে।
নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের নয়ন মাদবর কান্দি গ্রামের শিপন মোড়লের ছেলে কাইয়ুম হোসেন শিমুল জীবনে কোনোদিন ভাত খাননি। জন্মের পর ছয় মাস বয়সে প্রথমে মুখে ভাত দিলে বমি করে ফেলে দিত কাইয়ুম। তারপর তাকে আর কোনোদিনই ভাত খাওয়ানো যায়নি। কাইয়ুম ১৮ বছর ধরে মুড়ি, রুটি, তরকারি, মাছ, মাংস ও ফলমূল খেয়ে বেঁচে আছেন।
গ্রামের ঠাকুর কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও কাইয়ুম আর স্কুলে যায়নি। বর্তমানে সে বেকার ঘুরে বেড়ায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে কাইয়ুমের পরিবার একটি পাঁকা বসত ঘর পেয়েছে। তার পরিবারের সবাই ভাত খেলেও তিনি আজও পর্যন্ত ভাত মুখে নেননি।
কাইয়ুমের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চাল সিদ্ধ জাতীয় কোনো প্রকার খাবারই খেতে পারে না কাইয়ুম। এসব মুখে দিলেই তার বমি আসে। দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ, গরুর দুধ, আটার রুটি আর পাউরুটি খেয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুটির পাশাপাশি ডিম, মুড়ি ও ফলমূল খেতে শুরু করে। এখন বাড়িতে রান্না করা তরকারি ও মুড়ি তার প্রধান খাদ্য। এসব খেয়েই একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে আছেন তিনি। বন্ধুরা জোর করে কখনো ভাত খাইয়ে দিলে বমি করে ফেলে দেন।
কাইয়ুমের প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেন মোড়ল বলেন, কাইয়ুম সম্পর্কে আমার নাতি হয়। ছোটবেলা থেকেই সে ভাত খায় না। ভাতের ঘ্রাণও সে সহ্য করতে পারে না। সাদা ভাত, পোলাও, জাউ, খিচুড়ি ও খুদের ভাত কখনও খায়নি সে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে এগুলো খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। আমরা তার এই অস্বাভাবিক খাওয়া দেখে আশ্চর্য হই।
আরেক প্রতিবেশী রেনু বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকে কাইয়ুম ভাত খায় না। ভাত সে ঘৃণা করে। রুটি, মুড়ি, ফলমূল খেয়ে একটা মানুষ যে বেঁচে থাকতে পারে তার উদাহরণ কাইয়ুম।
কাইয়ুম হোসেন শিমুলের বন্ধু ফয়সাল খান বলেন, ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। তাকে কখনও ভাত খেতে দেখিনি। আমরা যদি দুষ্টুমি করে কখনও তাকে ভাত খাইয়ে দেই সে বমি করে ফেলে দেয়।
কাইয়ুম মোড়লের মা শাহিনুর বেগম বলেন, আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে কাইয়ুমের এই ব্যতিক্রম খাওয়ার চাহিদা আমাদেরকে কষ্ট দেয়। ওর বাবা ভ্যানচালক। ভ্যান চালিয়ে বেশি উপার্জন করা যায় না। ভাত ছাড়া অন্য কিছু খেতে হলে তো খরচ বেশি হয়। তারপরও ছেলে ভাত না খাওয়ায় তার জন্য আলাদা খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি ভাত খাওয়ানোর জন্য। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।
কাইয়ুমের বোন শিমু আক্তার বলেন, আমাদের পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শুধুমাত্র আমার বাবা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তার খাবার কেনা আমাদের জন্য দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাইয়ুমকে ভাত খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে ডাক্তার, কবিরাজ ও ফকির দেখানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই ফল না পাওয়ায় এখন আর চেষ্টা করা হয় না।
কাইয়ুম হোসেন শিমুল বলেন, আমি আমার জীবনে কোনো দিন ভাত খাইনি। ভাতের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না। ভাত, পোলাও, জাউ, খিচুড়ি ও খুদের ভাত দেখলেই আমার বমি আসে। বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমি মাংস ও মাছ খাই। পোলাওসহ অন্যান্য চাল সিদ্ধ জাতীয় খাবার খাই না।
শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন আবুল হাদি মোহাম্মদ শাহ পরান বলেন, কাইয়ুমের ১৮ বছর ধরে ভাত না খাওয়ার ঘটনায় আশ্চর্য হয়েছি। সে কেন ভাত খায় না, ভাত খেলে কেনই বা বমি আসে তা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করে বলা যাবে না। কাইয়ুমের ভাত না খাওয়ার বিষয়ে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছি। প্রয়োজনে আমরা তাকে চিকিৎসা দেব।