আওয়ামী লীগ সরকার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) আধুনিক ও যুগোপযোগী করে পুনর্গঠন করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, বিজিবি একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) পিলখানাস্থ সদর দপ্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দিবস ২০২২ উদযাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বাহিনীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বর্তমান সরকার এ বাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে পুনর্গঠন করেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতা সবসময়ই অব্যাহত থাকবে। জাতির পিতার প্রত্যাশিত আধুনিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে বিজিবি একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
দিবসটি উপলক্ষে ঢাকার পিলখানাস্থ সদর দপ্তর বিজিবির বীর উত্তম আনোয়ার হোসেন প্যারেড গ্রাউন্ডে বিজিবি দিবসের আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ শুরু হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছালে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক অভ্যর্থনা জানান।
পরে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং বিজিবিতে বীরত্ব ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিজিবি সদস্যদের পদক প্রদান করেন। এ অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন ইপিআরের ৩য় ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণের কিয়দংশ ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বাহিনীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে এর পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন-২০১০’ প্রণয়নসহ বিজিবিকে একটি বিশ্বমানের আধুনিক, দক্ষ ও শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১’ এর পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
‘এরই ধারাবাহিকতায় বাহিনী পুনর্বিন্যাস করে বিজিবি’র সাংগঠনিক কাঠামোতে ৫টি রিজিয়নসহ নতুন নতুন সেক্টর ও ইউনিট সৃজন করে কমান্ডস্তরে ভারসাম্য আনাসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯২২ জন নারী সৈনিকসহ সৈনিক ও অসামরিক পদে ৩৫ হাজারের অধিক জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। আরও ১৫ হাজার জনবল নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ বাহিনীর জনবল আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ ৯০ থেকে ৯৫ হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।”
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে একটি যুগোপযোগী ও আধুনিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র এয়ার উইং সৃজন করে ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক এমআই-১৭১-ই প্রযুক্তির হেলিকপ্টার সংযোজনের মাধ্যমে এ বাহিনীকে একটি ‘ত্রিমাত্রিক বাহিনী’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, বিজিবি এখন জল, স্থল ও আকাশ পথে দায়িত্ব পালনে সক্ষম। দেশের সীমান্ত এলাকায় নিশ্ছিদ্র নজরদারি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তে ‘স্মার্ট ডিজিটাল সার্ভেইল্যান্স অ্যান্ড ট্যাকটিক্যাল বর্ডার রেসপন্স সিস্টেম’ স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিজিবির সাংগঠনিক কাঠামোতে অত্যাধুনিক আর্মাড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), রায়ট কন্ট্রোল ভেহিক্যাল, অল ট্যারেইন ভেহিক্যাল (এটিভি), আধুনিক ও যুগোপযোগী এন্টি ট্যাংক গাইডেড উইপন, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন সিরিজের হাইস্পিড বোট এবং এয়ার বোট সংযোজন করা হয়েছে। বিজিবিতে এসব অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি যুক্ত হওয়ায় এ বাহিনীর আভিযানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সৈনিকদের মনোবল ও কর্মউদ্দীপনা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য সীমান্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং দুর্গম পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বমোট ১,০৩৬ কিঃ মিঃ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ১ম পর্বে ৩১৭ কিঃ মিঃ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এর ফলে সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিজিবির আভিযানিক কর্মকাণ্ড সহজতর হবে। ভারত এবং মায়ানমার সীমান্তে ০৪টি ব্যাটালিয়ন এবং সুন্দরবন এলাকায় ২টি ভাসমান বিওপিসহ মোট ৬২টি বিওপি সৃজনের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৫শত কিঃ মিঃ অরক্ষিত সীমান্তের মধ্যে অধিকাংশ সীমান্তই ইতোমধ্যে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
‘এছাড়াও সীমান্তে বিজিবির সক্ষমতা বৃদ্ধি, অপারেশনাল কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়ন এবং নজরদারি জোরদার করার জন্য বিওপি’র দায়িত্বপূর্ণ এলাকা কমানোর লক্ষ্যে ২৪২টি নতুন বিওপি সৃজন এবং সীমান্ত হতে অধিক দূরত্বে স্থাপিত ১২৬টি বিওপি সীমান্তের সন্নিকটে স্থানান্তরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
বিজিবি সৈনিকদের জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকার বিভিন্ন ধরনের কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজিবি সদস্যদের নতুন র্যাংক ব্যাজ প্রবর্তন, যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি, সীমান্ত ভাতা বৃদ্ধি, জুনিয়র কর্মকর্তা ও হাবিলদার পদবির সদস্যদের বেতন স্কেল উচ্চ ধাপে উন্নীতকরণ, অগ্রিম বেতনসহ বাৎসরিক ২ মাসের ছুটি প্রদান, পারিবারিক রেশন ও ৩ বছরের নীচে সন্তানদের পূর্ণস্কেল রেশন প্রদানসহ বিজিবি সদস্যের প্রতিবন্ধী সন্তানদের অবসরের পূর্ব পর্যন্ত নগদমূল্যে রেশন প্রদান এবং জ্বালানি, মসলা, চুলকাটা ও পোষাক ধোলাই ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিজিবি সদস্য ও তাদের পরিবারের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য বর্ডার গার্ড হাসপাতাল, ঢাকায় ক্যাথ ল্যাব, সিসিইউ, আরটিপিসিআর ল্যাব, ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপনসহ আরও অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সংযোজন করে বিজিবি হাসপাতালসমূহকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে।
প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেকোনো পেশাদার বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুশৃঙ্খল ও দক্ষ বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। বিজিবি সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য সাতকানিয়ার ‘বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজ’ এর পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গায় অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ সুবিধা সম্বলিত আরও একটি প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বিজিবির মনোমুগ্ধকর কুচকাওয়াজ বিশেষ করে নারী সৈনিকদের ড্রিল দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি বিজিবিতে বীরত্ব ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পদক প্রাপ্তদের অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, ‘শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড একটি বাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি।’ তিনি বিজিবির প্রতিটি সদস্যকে চেইন অব কমান্ড এবং কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনে চলার আহবান জানান।
তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পিলখানায় এসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ঈমানের সাথে কাজ করো, সৎ পথে থেকো, দেশকে ভালোবাস।’ তিনি সব বিজিবি সদস্যকে বঙ্গবন্ধুর এই চিরন্তন দিক নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানান।
দিনরাত নিরবিচ্ছিন্ন আভিযানিক কার্যক্রম এবং নজরদারির মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, মাদক ও নারী-শিশু পাচার রোধের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনসহ দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদান, বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বলপূর্বক বাস্তচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অবৈধ মিয়ানমার নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবির ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী সব বিজিবি সদস্যের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ভবিষ্যতে এই সফলতা আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজিবি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।