বাংলা চলচ্চিত্রের মিয়াভাই খ্যাত নায়ক, মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা ১৭ আসনের সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক) আর নেই। গত সোমবার (১৫ মে) স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্রাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংস্কৃতি অঙ্গণের মানুষজন ছাড়াও তার ভক্ত-অনুরাগীরা শোক প্রকাশ করছেন। চলচ্চিত্রে ফারুক এক বর্নাঢ্য জীবন অতিবাহিত করেন। ফারুক ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে এইচ. আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ সিনেমায় অভিনয়ের মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক হয়। তার বিপরীতে নায়িকা হিসেবে ছিলেন কবরী। ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত ‘সুজন সখী’ ও ‘লাঠিয়াল’ সিনেমা দিয়ে তিনি ব্যাপক আলোচনায় চলে আসেন। ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত তিনটি চলচ্চিত্র ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘মাটির মায়া’ ও ‘নয়নমনি’। চলচ্চিত্র তিনটি বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। পরের বছর শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত কালজয়ী উপন্যাস ‘সারেং বৌ’ অবলম্বনে নির্মিত আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ও আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। দুটি চলচ্চিত্র তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে তিনি পরপর ‘নাগরদোলা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘কথা দিলাম’, ‘ঝিনুক মালা’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘এতিম’, ‘ঘরজামাই’, ‘সখী তুমি কার’সহ আরো বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত। পরবর্তীতে ‘মিয়া ভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ফারুকের স্বপ্ন ছিল, নিজের গল্প ভাবনায় অন্ততঃ একটি হলেও সিনেমা নির্মাণ করা। তিনি গল্প নিয়ে ভেবেছিলেনও। চলচ্চিত্রের বাইরে ফারুক একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। গাজীপুরে অবস্থিত নিজের শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘ফারুক নিটিং ডাইং এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অন্যদিকে, তিনি স্কুল জীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এ সময়ে তার নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ফারজানা পাঠানকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ফারুক। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। কন্যা ফারিহা তাবাসসুম পাঠান ও পুত্র রওশন হোসেন। ফারুক ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। ফারুক এই বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন খুব কম হয়। নতুন প্রজন্মকে আমরা এখনো মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস বলতে পারলাম না। এখনো আমরা চেয়ার দখল নিয়েই ব্যস্ত। আমার কথা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে হবে। যাঁরা জীবন দিয়েছেন এবং যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। নায়ক ফারুক অভিনীত আরো উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘দোস্তী’,‘ সোনার তরী’,‘ জনতা এক্সপ্রেস’, ‘মাসুম’, ‘হাসু আমার হাসু’, ‘মায়ের আঁচল’,‘ ফুলেশ^রী’, ‘পরীস্থান’,‘ সুদ আসল’,‘ জীবন সংসার’, ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘দাদী মা’ ইত্যাদি। ২০১৬ সালে ফারুক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘আজীবন সম্মাননা’য় ভূষিত হয়েছিলেন।